হোম > সারা দেশ > চট্টগ্রাম

ভালো নেই ওয়েল গ্রুপ

ওমর ফারুক, চট্টগ্রাম

পোশাক খাতে দেশের অন্যতম রপ্তানিকারক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ‘ওয়েল গ্রুপ’। বেকারি পণ্য ও হোটেল ব্যবসায়ও সুনাম রয়েছে গ্রুপটির। বছরে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা রপ্তানি আয়ের রেকর্ড রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। কর্ণধার আব্দুচ ছালামের শ্রম ও ঘামে তিলে তিলে শূন্য থেকে শীর্ষ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে ওয়েল গ্রুপ।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ১৯৯০ এর দশকে নিজের কাঁধে ও মাথায় নিয়ে পোশাক কারখানাগুলোতে সুতা বিক্রি করেছেন আব্দুচ ছালাম। এরপর ট্রেডিং থেকে কারখানার মালিক। গত তিন দশক একটানা ছিল গ্রুপটির উত্থানের গল্প। তবে বর্তমানে ভালো নেই ওয়েল গ্রুপ। গ্রুপটির কর্ণধারদের ব্যবসায়ী থেকে নেতা হওয়ার স্বপ্ন, করোনার প্রভাব, বারবার গ্যাস-বিদ্যুৎ ও ডলারের দাম বাড়া এবং দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে আজ বিপাকে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

বিনিয়োগকারী ব্যাংক ও ওয়েল গ্রুপের বাণিজ্যিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ সাল পর্যন্ত ওয়েল গ্রুপের বার্ষিক রপ্তানি আয় ছিল ৯-১০ কোটি ডলার (১ হাজার ২০০ কোটি টাকা)। এর সিংহভাগ এসেছে রপ্তানি পোশাক থেকে। তখন গ্রুপটির ১৯টি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২৫ হাজার কর্মী নিয়োজিত ছিলেন।

কিন্তু চার-পাঁচ বছর ধরে গ্রুপটির ব্যবসা নিম্নমুখী। পোশাক রপ্তানি করে বছরে ৫ কোটি ডলারের (৬০০ কোটি টাকা) বেশি আয় করা গ্রুপটির পোশাক খাতের উৎপাদন এখন বন্ধ। কর্মীর সংখ্যা নেমে এসেছে ৫ হাজারের মধ্যে। হোটেল, বেকারি, ট্রেডিং ও অ্যাগ্রো খাতের ব্যবসাগুলো কোনোভাবে টিকে আছে।

খরচের চেয়ে আয় কমে যাওয়ায় শোধ করতে পারছে না ব্যাংকঋণ। এতে গ্রুপটির কাছে ২৮টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ করা প্রায় ১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হতে শুরু করেছে।

সময়মতো ঋণ শোধ করতে না পারায় এরই মধ্যে একটি ব্যাংক গ্রুপটির বন্ধক রাখা সম্পত্তি নিলামে তুলেছে। একই ব্যাংকের দুটি চেক প্রত্যাখ্যান (এনআই অ্যাক্ট) মামলায় গ্রুপটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আদেশ দেন চট্টগ্রামের আদালত।

পাওনাদার ব্যাংকগুলোর তথ্য বলছে, ওয়েল গ্রুপের ১৯টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ২৮ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট ১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা পাওনা আটকে গেছে। এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৫৪৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সানজি টেক্সটাইল মিলস। এ ছাড়া ওয়েল মার্ট (টেক্সটাইল) ২৬৬ কোটি, ওয়েল ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ ২১৩ কোটি, ওয়েল কম্পোজিট ১৬৬ কোটি, ওয়েল ফ্যাব্রিকস ১৪৯ কোটি, মেসার্স ওয়েল ট্রেড ৯১ কোটি, ওয়েল অ্যাকসেসরিজ ৮১ কোটি, ওয়েল মার্ট (টেক্সটাইল-২) ৬২ কোটি, ওয়েল ড্রেসেস লিমিটেড ৫০ কোটি, ওয়েল ফুডস লিমিটেড ২৭ কোটি, ওয়েল মার্ট (গার্মেন্টস) ২১ কোটি, ওয়েল ডিজাইনার্স ২০ কোটি, ওয়েল ফ্যাশন লিমিটেড ১৯ কোটি, ওয়েল ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড মার্কেটিং ১৯ কোটি টাকা, ওয়েল পার্ক রেসিডেন্স ১৮ কোটি, আব্দুচ ছালাম অ্যান্ড ব্রাদার্স ১১ কোটি, ওয়েল ফ্যাশন লিমিটেড (ইউনিট-২) ৬ কোটি, ওয়েল অ্যাগ্রো অ্যান্ড ডেইরি ৪ কোটি এবং ওয়েল ডিজাইনার্স ওয়াশিংয়ে ঋণের পরিমাণ ৩ কোটি টাকা।

ওয়ান ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, ওয়েল গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে ওয়ান ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার ৮৩ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এই ঋণ আদায়ে গ্রুপটির সাত কর্ণধারের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে দুটি চেক প্রত্যাখ্যান মামলা করেছে ব্যাংক। মামলা দুটিতে কর্ণধারদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আদেশ দিয়েছেন চট্টগ্রামের সংশ্লিষ্ট আদালত।

একই সঙ্গে এই পাওনা আদায়ে গ্রুপটির একটি নয়তলা ভবনসহ ২০ শতক জমি নিলামে তুলেছে ওয়ান ব্যাংক। ব্যাংকের কাছে বন্ধক থাকা ওয়েল ডিজাইনার্স নামের ভবনটি (কারখানা) নগরীর কালুরঘাট শিল্প এলাকায় অবস্থিত।

বেসিক ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কোম্পানি গঠনের পর অর্থাৎ ১৯৯৬-৯৭ সালের দিকে ওয়েল গ্রুপে প্রথম বড় বিনিয়োগ করে বেসিক ব্যাংক। ব্যাংকটির জুবিলী রোড শাখার এই বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ টাকা। এরপর ধীরে ধীরে গ্রুপটির ব্যবসার পরিসর বড় হয়। তবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংকটে তিন-চার বছরে নগদ অর্থের সংকটে ভুগছে গ্রুপটি। এতে গ্রুপটির কাছে বেসিক ব্যাংকের ১৬১ কোটি টাকা আটকে গেছে।

ব্যাংকগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ওয়েল গ্রুপের কাছে বিনিয়োগ করা ২৮ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওনা আটকে গেছে এনসিসি ব্যাংকের। গ্রুপটির ৯টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির আগ্রাবাদ শাখার পাওনা ২৭০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ইউসিবিএলের ২১৪ কোটি, আইএফআইসি ২০৭ কোটি, বেসিক ব্যাংক ১৬১ কোটি, পূবালী ব্যাংক ১৩৭ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ১০৭ কোটি, ট্রাস্ট ব্যাংক ১০৭ কোটি, ওয়ান ব্যাংক ৮৩ কোটি, ঢাকা ব্যাংক ৭৪ কোটি, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৩১ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ২৪ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংক ২১ কোটি, সাউথইস্ট ২০ কোটি, মধুমতি ব্যাংক ২০ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ১৮ কোটি, মিডল্যান্ড ব্যাংক ১৮ কোটি, উত্তরা ফাইন্যান্স ১৮ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১৪ কোটি, ইসলামী ব্যাংক ১২ কোটি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ১০ কোটি, এনআরবি ব্যাংক ৯ কোটি, এবি ব্যাংক ৮ কোটি, মেঘনা ব্যাংক ৮ কোটি, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ৮ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংক ৪ কোটি, আইডিএলসি ৪ কোটি, আইআইডিএফসি ৪ কোটি এবং উত্তরা ফাইন্যান্সের ৬৪ লাখ পাওনা আটকে গেছে।

আইএফআইসি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৬ সালে আইএফআইসি ব্যাংকে ব্যবসা শুরু করে ওয়েল গ্রুপ। গ্রুপটির কাছে ব্যাংকটির আগ্রাবাদ শাখার বর্তমান পাওনা ২০৭ কোটি টাকা। এক বছর ধরে সময়মতো কিস্তি শোধ না করায় ঋণগুলো এরই মধ্যে শ্রেণীকৃত হয়ে পড়েছে।

ওয়েল গ্রুপের কাছে ১৩৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ আটকে গেছে পূবালী ব্যাংক সিডিএ শাখার। এ বিষয়ে ব্যাংকটির জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ আব্দুর রহিম বলেন, ‘রপ্তানিমুখী শিল্পগোষ্ঠী ওয়েল গ্রুপ ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে দুই ডজনের বেশি ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ করা ঋণ ঝুঁকিতে পড়বে। গ্রুপটি রুগ্‌ণ হয়ে পড়ায় এরই মধ্যে অনেক মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত নীতিসহায়তা পেতে গ্রুপটি ব্যাংকে আবেদন করেছে। আমরা সেই আবেদন প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছি। নীতিসহায়তার মাধ্যমে ঋণ পরিশোধের দীর্ঘ মেয়াদি সুযোগ এবং ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল পেলে দেশের অন্যতম রপ্তানিমুখী গ্রুপটি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।’

ওয়েল গ্রুপের পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যবসা ছেড়ে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়াই আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে গ্রুপের কর্ণধারদের কেউ কেউ সিডিএ চেয়ারম্যান, সংসদ সদস্য ও বিজিএমইএ নেতা হয়েছেন ঠিকই; এতে মানুষের সেবা করার সুযোগ হলেও ব্যবসায় সময় না দিতে পারায় গ্রুপের ক্ষতি হয়ে গেছে। এ ছাড়া করোনাকালীন পোশাক রপ্তানিতে ধস, বারবার গ্যাস-বিদ্যুৎ ও ডলারের দাম বাড়ায় গত পাঁচ বছর বড় অঙ্কের লোকসান হয়েছে গ্রুপের।’

এই কর্ণধার আরও বলেন, ‘আমাদের সব কটি প্রতিষ্ঠান ওয়েল এস্টাবলিশড এবং শতভাগ কমপ্লায়েন্স মেইনটেইন করে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা পেলে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারব।’

উল্লেখ্য, ওয়েল গ্রুপের প্রধান উদ্যোক্তা ও বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালাম ২০০৫ সালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে চট্টগ্রাম নগর কমিটির কোষাধ্যক্ষ হন। এরপর ২০০৯ থেকে ১০ বছর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ আসন (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) থেকে সংসদ সদস্য হন।

গ্রুপটির পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম ব্যবসার পাশাপাশি ২০১১ সালে পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক হন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিলুপ্ত হওয়া ২০২৩-২০২৫ কমিটির প্রথম সহসভাপতি হিসেবেও দায়িত্বে ছিলেন তিনি। অপর পরিচালক নুরুল ইসলামও ২০২০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী হওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করেন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে রয়েছেন আব্দুচ ছালাম। বাকি সহোদরেরাও সাবধানে চলাফেরা করছেন।

গত ২ জুন গ্রুপটির একটি কারখানায় পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) পোশাক তৈরি করা হচ্ছে সন্দেহে গ্রুপটির পরিচালক তরিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এতে নতুন করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে গ্রুপটি। কেএনএফের পোশাক তৈরির বিষয়ে ওয়েল গ্রুপের বাণিজ্যিক বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের জব্দ করা পোশাকগুলো ওয়েল গ্রুপে তৈরি করা হয়নি। অপর একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি এসব পোশাকের শুধু ডাইং ও প্রিন্টিং করা হয় ওয়েল ফ্যাব্রিকস কারখানায়।

আরও খবর পড়ুন:

হাদি হত্যার বিচারের দাবিতে চট্টগ্রামে সড়ক অবরোধ, দুর্ভোগ

দরপত্র ছাড়াই ভাড়া ২৪ শতাংশ জমি

চট্টগ্রামে ঝুলে আছে একটি আসন, অপেক্ষায় বিএনপির ১১ মনোনয়নপ্রত্যাশী

চট্টগ্রামে কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দিল জিপিএইচ ইস্পাত

বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে এসে গ্রেপ্তার ছাত্রলীগ কর্মী

হাদি হত্যাকাণ্ড: চট্টগ্রামে নিউমার্কেট চত্বরে ইনকিলাব মঞ্চের অবস্থান কর্মসূচি চলছে, সড়কে যানজট

এক হাজার লিটার ডিজেল, ৬৫০ বস্তা সিমেন্টসহ আটক ১১

সেন্ট মার্টিনগামী জাহাজে আগুন, এক কর্মচারী নিহত; ১৫ জন জীবিত উদ্ধার

সীতাকুণ্ডে জমির সীমানা নিয়ে বিরোধে বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ

চট্টগ্রামে হাদি হত্যার বিচার দাবিতে ইনকিলাব মঞ্চের বিক্ষোভ