হোম > গোলটেবিল

‘মাসিক’ নিয়ে জনসমক্ষে আলাপ ও সচেতনতা চাই

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

মাসিক স্বাস্থ্যবিধি দিবস উপলক্ষে গতকাল আজকের পত্রিকার আয়োজনে ‘মাসিকবান্ধব বিশ্বের জন্য একতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত অতিথিরা। অনুষ্ঠান আয়োজনে সহযোগিতায় ছিল পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার এবং ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড প্যারেন্টহুড ফেডারেশন। ছবি: আজকের পত্রিকা

নারীর মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা নিয়ে জনসমক্ষে আলোচনা ও সচেতনতা জরুরি। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কার ভেঙে বিষয়টিকে নারী ও পুরুষ সবার কাছে সহজ ও স্বাভাবিক করে তুলতে সবাইকে কাজ করতে হবে। স্যানিটারি প্যাডের সহজলভ্যতা, তা ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকা এবং ব্যবহারের পরে পরিবেশসম্মতভাবে ফেলে দেওয়ার দিকেও লক্ষ রাখা দরকার। মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষায় দেশে ইতিবাচক কিছু পরিবর্তন এলেও এখনো অনেক কিছু করার বাকি।

নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ, নারী অধিকারকর্মী এবং পর্যবেক্ষকেরা গতকাল রোববার দৈনিক ‘আজকের পত্রিকা’ আয়োজিত ‘মাসিকবান্ধব বিশ্বের জন্য একতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এমন অভিমত দিয়েছেন।

মাসিক স্বাস্থ্যবিধি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা নারীর মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা নিয়ে নানা পর্যায়ের আলোচনা করেন। ‘আজকের পত্রিকা’ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই বৈঠক আয়োজনে সহযোগিতা করেছে জনসংখ্যা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (পিএসটিসি) এবং প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড প্যারেন্টহুড ফেডারেশন (আইপিপিএফ)।

পিএসটিসির নির্বাহী পরিচালক ডা. নূর মোহাম্মদের সঞ্চালনায় আয়োজনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন পিএসটিসির টিম লিডার অনিতা শরীফ চৌধুরী। তিনি বলেন, বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ নারী ট্যাবু (নিষিদ্ধ বিষয়) ও কুসংস্কারের কারণে মাসিক নিয়ে কথা বলেন না। এ কারণে তাঁরা সঠিকভাবে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করতে পারেন না। অন্য দিকে মাসিক ব্যবস্থাপনার সরঞ্জামাদি, নারীবান্ধব টয়লেট ব্যবস্থা, মাসিক সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সচেতনতা না থাকায় নারীর স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নারী, পথ বা বস্তির তরুণী এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীরা বেশি সমস্যার মধ্যে আছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাগ্রস্ত এলাকায়, বিশেষ করে বন্যার সময়ে মাসিক নিয়ে বড় সমস্যায় পড়েন নারীরা।

অনিতা শরীফের তুলে ধরা সার্বিক চিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা নিয়ে আলোচনা করেন বিশেষজ্ঞসহ অতিথিরা।

বক্তারা নগর থেকে শুরু করে গ্রামীণসহ প্রান্তিক পর্যায়ে নারীর মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষার চ্যালেঞ্জের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁরা চ্যালেঞ্জগুলো উত্তরণের সম্ভাব্য উপায় নিয়েও কথা বলেন।

বৈঠকের সঞ্চালক পিএসটিসির নির্বাহী পরিচালক ডা. নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘মাসিক নিয়ে আমরা যে কণ্ঠস্বর তৈরি করেছি, এটা ছড়িয়ে দিতে চাই। এটাই আমাদের এই সংলাপের মূল উদ্দেশ্য। পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষকে বোঝাতে হবে যে এটা নিষিদ্ধ কোনো বিষয় নয়। শিক্ষকদের বলতে হবে, এটা বাসায় নয় শিক্ষার্থীদের সামনেই আলোচনা করতে হবে।’

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ) রেজিনা আরজু লাভলী বলেন, এ ধরনের বৈঠক হওয়া জরুরি। তবে গবেষণা, সেমিনার ইত্যাদির তুলনায় প্রয়োগ কতটুক হচ্ছে? তাই স্বল্প মেয়াদে পাইলট আকারে কিছু করা যায় কি না, সেটা ভাবা দরকার।

পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষকে বোঝাতে হবে যে মাসিক নিষিদ্ধ কোনো বিষয় নয়। ডা. নূর মোহাম্মদ পিএসটিসির নির্বাহী পরিচালক

পরিবারের সংস্কার ভাঙার একটি উৎসাহব্যঞ্জক উদাহরণ দেন পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. মনজুর হোসাইন। তিনি বলেন, ‘১৯৮০ সালের কথা। আমার খালাতো বোনের প্রথম মাসিক হয়েছে। খালা খালুকে বললেন, তোমার মেয়ের শরীর খারাপ করেছে। খালু শুনে বাজার থেকে প্যাড আর মিষ্টি নিয়ে এলেন। খালার কাছে প্যাডটা দিয়ে বললেন, এটা মেয়ের ব্যবস্থাপনার জন্য। খালা জিজ্ঞেস করলেন, মিষ্টি কিসের জন্য? খালু বললেন, এই মিষ্টি তুমি সবাইকে বিলিয়ে বল যে আমার মেয়ের মাসিক হয়েছে। খালার প্রতিক্রিয়া ছিল, এ রকম একটা শরমের বিষয় আমি কীভাবে মানুষকে বলব? খালু বললেন, “আমি তো আজকে আশ্বস্ত হলাম যে আমার মেয়েটা স্বাভাবিক।” সুতরাং আমি বলতে চাই, মাসিক একটি স্বাভাবিক বিষয়। এ সম্পর্কে আমাদের যে লজ্জা ভয় তা থাকার কোনো কথা নয়।’

শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এমডিএফের বাংলাদেশ কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রশিক্ষক মাহবুবা হক কুমকুম ব্যবহৃত স্যানিট্যারি প্যাড নষ্ট করার (ডিসপোজাল) সমস্যাটি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিশেষ করে বন্যার সময় কেমন হবে, স্কুল-কলেজে কীভাবে হবে। গ্রাম বা প্রান্তিক অঞ্চলে আরও সমস্যা।

পিএসটিসির হেড অব প্রোগ্রামস ডা. মো. মাহবুবুল আলম বলেন, মাসিকের সঠিক ব্যবস্থাপনা না করা হলে স্বাস্থ্যের ইস্যু আসে। তাই এটাকে স্বাস্থ্যের সঙ্গে চিন্তা করতে হবে।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাবেক বিএসএমএমইউ) সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারিহা হোসেন বলেন, ‘আমাদের মেয়েদের স্কুলে অনুপস্থিত থাকার গুরুত্বপূর্ণ একটা কারণ হলো, অপরিষ্কার টয়লেট ওরা ব্যবহার করতে চায় না।’

ফেমিনিস্ট অপরচুনিটিস নাউ, ক্রিয়া-এর প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর সাঈদা বাণী শহরের প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ কতটা নারীবান্ধব, সেই প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় বিষয়টি যুক্ত আছে কি না। যে নারীরা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন মাসিকের দিনগুলোতে তাঁদের অফিসের ডেস্কে কাজ দেওয়া যায় কি না দেখতে হবে।

আইপাস বাংলাদেশের সিনিয়র অ্যাডভাইজর সুস্মিতা আহমেদ বলেন, ‘আম্মা বলতেন, মাসিকের কাপড় এমন জায়গায় মেলে দিতে হবে আব্বা যেন না দেখে। সেখান থেকে এক ধাপ এগিয়েছি। আমার মেয়েকে বলেছি, তোমার মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাডের কথা বললে বাবা কিনে এনে দেবে। আমার মেয়ে তার বাবার কাছে প্যাড চাইতে শিখেছে। এটা একটা উত্তরণ।’

রেডঅরেঞ্জ কমিউনিকেশনসের হেলথ কমিউনিকেশন ডিরেক্টর ডা. ফারহানা হক বলেন, মাসিকের বিষয়টাকে কিশোরীদের কাছে এমনভাবে ভয়াবহ করে তোলা হয় যে তারা আতঙ্কিত হয়ে যায়।

পিএসটিসির প্রজেক্ট ম্যানেজার কানিজ গোফরানি কুরাইশি বলেন, একই দিন (২৮ মে) নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। এ বিষয়টাও মাসিকের সঙ্গে সম্পর্কিত। মাসিকের ব্যবস্থাপনা যদি সঠিক না হয়, মাতৃত্ব তখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়।

মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় মাসিকের বিষয়টি যুক্ত আছে কি না দেখতে হবে। সাঈদা বাণী প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর, ফেমিনিস্ট অপরচুনিটিস নাউ, ক্রিয়া

বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটির (জিএফএফ) কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর নন্দিনী লোপা মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সরঞ্জামগুলো সুলভে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে নিয়ে যাওয়ার উপায় নিয়ে আলোচনায় জোর দেন।

পিএসটিসির প্রজেক্ট ম্যানেজার মাহমুদা নাসরিন মনে করেন বস্তির মেয়েদের জন্য স্যানিটারি প্যাড বেশ কাজের। কারণ বস্তির একটা বাথরুম ২০টি পর্যন্ত পরিবার ব্যবহার করে। তবে তাদের নিজে থেকে প্যাড কেনার আর্থিক সমস্যা আছে।

ন্যাশনাল ইয়ুথ নেটওয়ার্কের চেয়ারপারসন প্রিয়তা মণ্ডল বলেন, মেয়েরা যেন মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সঠিকভাবে জানতে পারে এবং বলতে পারে এমন স্বাভাবিক পরিবেশ চাই। এ ছাড়া পিরিয়ডকালীন শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি নিশ্চিত করা এবং মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার পণ্যগুলো সহজলভ্য করা দরকার।

বৈঠকে নিজের অভিজ্ঞতা জানান তরুণেরাও। ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ন্যাশনাল ইয়ুথ নেটওয়ার্কের সদস্য তাহরিমা তাসলিম স্যানিটারি ন্যাপকিন সুলভে পাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শুভাশীষ কুমার ইমন বললেন, এখনকার তরুণেরা দীর্ঘ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাটান। কিন্তু সেখানে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে তথ্য খুব একটা পাওয়া যায় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার বলেন, বাসার বাইরে থাকার সময় প্যাড লাগলে পুরো প্যাকেট কিনতে হয়। দোকানে খুচরা প্যাডের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো।

গোলটেবিল বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন দৈনিক আজকের পত্রিকার সম্পাদক ড. গোলাম রহমান। তিনি বলেন, ‘ইস্যুটি এখনো আমাদের সমাজে ট্যাবু হিসেবে আছে। এটা ভাঙতে উদার মনে সচেতনভাবে নাগরিক দায়িত্ব পালন প্রয়োজন।’

বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন দৈনিক আজকের পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কামরুল হাসান এবং পিএসটিসি ও আজকের পত্রিকার বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা।

দিলরুবা হক মিলি: বনরক্ষী এক নারীর গল্প

অতীতের আলো, বর্তমানের অন্ধকার

জন্মনিবন্ধন করতে বাবার এনআইডি বা তথ্য বাধ্যতামূলক নয়

নারী আন্তর্জাতিক পেশাদার বক্সিংয়ে হিজাব, নিরাপত্তা নাকি প্রথা

পরিবেশ নিয়ে সরব দুই অভিনেত্রী

বিস্মৃত ছবিতে সামনে এল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নারীদের নেতৃত্ব

‘সচেতনতার অভাব ও সামাজিক কাঠামোর বৈষম্য নারীদের এগিয়ে যেতে বাধা দিচ্ছে’

‘নারীর সাফল্য অনেক পুরুষকে শঙ্কিত করে, এই শঙ্কাই সহিংসতা বাড়িয়ে দিচ্ছে’

রীমার ‘আয়নাবিবির গহনা’

শ্বশুর-শাশুড়ি বা অন্য কেউ স্বামীর হয়ে তালাক দিতে পারেন না