দেয়ালচিত্রে বদলে গেছে বাফুফে ভবনের চেহারা। গতকাল ‘হোম অব ফুটবল’ ছিল নীরবতায় ঢাকা। টানা দুটি ম্যাচ, বিশেষ করে ভারত ম্যাচ আয়োজনের ধকল কাটিয়ে উঠতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছিলেন ছুটিতে। ২২ বছর পর পাওয়া জয়ে সবার মনে বইছে আনন্দের স্রোত।
বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে এক বিশেষ দিন হয়ে থাকবে ১৮ নভেম্বর। শেখ মোরসালিনের গোলে ১-০ ব্যবধানের অবিস্মরণীয় জয়ে রাতে কেক কেটে, নেচে-গেয়ে উদ্যাপন করেন ফুটবলাররা। অধিকাংশ ফুটবলার রাতেই ছেড়েছেন হোটেল। হামজা চৌধুরী সকালে রওনা দিয়েছেন ইংল্যান্ডের পথে। কানাডা প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ না থাকায় এই ফাঁকে শমিত সোম ছুটে গেছেন শ্রীমঙ্গলে। ফুটবলার হিসেবে এবারই প্রথম গ্রামের বাড়ি গেলেন তিনি।
দুই দিন পেরিয়ে গেলেও জয়ের রেশ এখনো কাটেনি। ম্যাচে বাংলাদেশ হয়তো সেভাবে গোছানো খেলাটা খেলতে পারেনি। তবে ফুটবলে জয়ই শেষ কথা। জয় দিয়ে বছর শেষ করতে পারার তৃপ্তি হয়তো বলে বোঝানো যায় না। সেই রেশ তখনই হতাশায় মোড় নেবে, যখন প্রশ্ন করা হবে, বছরটা কেমন হলো বাংলাদেশের।
হয়তো বলতে পারেন, হামজা এসেছেন, শমিত এসেছেন, দেশের ফুটবলে নতুন জোয়ার এসেছে। মানুষ এখন জাতীয় দল নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে, আগ্রহ বাড়িয়েছে। কিন্তু তেতো হলেও সত্যি, হামজা-শমিতদের নিয়েও এশিয়ান কাপের মূল পর্বে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। এই বছর আটটি ম্যাচ খেলে জয় এসেছে শুধু ভারত আর তুলনামূলক দুর্বল ভুটানের বিপক্ষে। নেপালকেও দুবারের দেখায় পারেনি হারাতে।
নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখানো প্রবাসী ফুটবলাররা হয়ে উঠছেন ফুটবলের আশার প্রতীক। এই নীতি শুধু বাংলাদেশই নয়, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও। কেপ ভার্দের কথাই ধরুন না। কজনই-বা চিনত প্রায় ৬ লাখ জনসংখ্যার ছোট দেশকে। অথচ বংশোদ্ভূত ফুটবলারদের ঘাড়ে চরে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে নাম লিখিয়েছে তারা। ভারত পর্যন্ত বাংলাদেশকে দেখে নিজেদের নীতি বদলেছে। বিশ্বকাপে না হোক, হামজা-শমিতদের নিয়ে অন্তত এশিয়ান কাপে খেলার স্বপ্ন তো দেখতেই পারে বাংলাদেশ। ১৯৮০ সালের পর যে স্বপ্ন অধরা হয়ে আছে এখনো।
গত পরশু সংবাদ সম্মেলনে হামজা তেমনই আশ্বাস দিলেন, ‘আমাদের এখনো কিছু ধাপ পেরোতে হবে। আমরা বারবার বলেছি, কোচও বলেছেন, সবাই একই কথা বলেছে—আমাদের পারফরম্যান্স হচ্ছে, এখন দরকার ফল। এখন হয়তো পারফরম্যান্স ছাড়াই ফল এসেছে। আমরা আবার মার্চে নতুন করে গড়তে শুরু করব এবং ইনশা আল্লাহ, তখন পারফরম্যান্স ও ফল—দুটোই একসঙ্গে এনে দল হিসেবে আরও শক্তিশালী হব।’
বাংলাদেশের পরের ম্যাচ সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে। অপেক্ষা করতে হবে আগামী বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত। এরপর আর কোনো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ এখন পর্যন্ত নেই বাংলাদেশের। বিশ্বকাপের বছরে সেভাবে থাকেও না। পরের ফিফা উইন্ডো প্রায় এক বছর পর সেই সেপ্টেম্বরে। সেটাও ঘরের মাঠে হবে কি না, নিশ্চয়তা নেই। তাই আগামী এক বছরে ঘরের মাঠে হামজা-শমিতদের খেলার সম্ভাবনা খুবই কম।
এই লম্বা বিরতিতে ফুটবলের প্রতি আগ্রহটা হয়তো হারাবে না। আমেজটা ধরে রাখতে হলে বাফুফের নজর দেওয়া উচিত ঘরোয়া ফুটবলে। ভারত ম্যাচ দিয়ে আর্থিকভাবে সফল হওয়ার কথা বেশ জোরগলায় শুনিয়েছেন বাফুফে সহসভাপতি ও মার্কেটিং কমিটির চেয়ারম্যান ফাহাদ করিম। অথচ ফুটবলের আসলে ব্র্যান্ডিংটা যে করতে হয় ক্লাব ফুটবল। সেটা হয়তো তিনিও উপলব্ধি করে থাকেন। তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। ঘরোয়া লিগ চলছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। ফুটবলাররা পাচ্ছেন না নিয়মিত পারিশ্রমিক। ক্লাবগুলোয় আসেনি আধুনিকতার ছোঁয়া। ফুটবলের জন্য নিবেদিত কোনো মাঠ না থাকার হাহাকার প্রায়শই শোনা যায় বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়ালের কণ্ঠে।
হামজা-শমিতরা বাংলাদেশের হয়ে নাম লেখানোর আগেই পেয়েছেন তারকাখ্যাতি। যে দেশে বড় হয়েছেন, সে দেশের উন্নত ফুটবল কাঠামো তাঁদের বড় মানের ফুটবলার হতে সহায়তা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবল খেলে বর্তমানে তারকা হয়েছেন কজন? একসময় ফুটবলারদের পরিচয়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকত ক্লাবের নাম—আবাহনীর অমুক, মোহামেডানের অমুক। সেই দৃশ্য ফিরে এলে তবেই পুনরুজ্জীবিত হতে পারে দেশের সামগ্রিক ফুটবল। শমিত যেমন শ্রীমঙ্গল ফিরে বললেন, ‘আশা করি, আমি এখানকার ফুটবলারদের অনুপ্রাণিত করতে পারব। তারা যদি ভালোভাবে অনুশীলন করে, কঠোর পরিশ্রম করে, তাহলে সুযোগ পাবে। আমি অনেক স্থানীয় খেলোয়াড়ের সঙ্গে কথা বলি, এরা তো শুধু ঢাকা নয়, ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে।’
সমর্থকেরাও এখন জাতীয় দলকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। ক্লাব ফুটবল তাদের খুব বেশি টানে না। ২৪ নভেম্বর শুরু হতে যাওয়া লিগে হয়তো চোখে পড়বে তা। সেদিনই কুমিল্লায় মুখোমুখি হবে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী-মোহামেডান।