ভালো খেলোয়াড় তো অনেকেই হয়। নামীদামি ভদ্র এমন খেলোয়াড়ে ভর্তি ক্রীড়া দুনিয়া। কিন্তু তর্ক-বিতর্ক আর মেধায় সমান ঝলসে ওঠা খেলোয়াড় কজন হতে পারে?
আমাদের সময়কালে আমি দুজনের কথা বলব। একজন ষাট বছর বয়সে বিদায় নেওয়া ডিয়েগো ম্যারাডোনা। নেশা-পেশা-ডোপ কত বিতর্ক, কিন্তু ফুটবলের ভগবানতুল্য ছিলেন এই প্রতিভা। আর একজন সদ্য বিদায়ি শেন ওয়ার্ন। তাঁর নামে কত গল্প, কত বাদ-অপবাদ, কিন্তু শেন তো শেনই। অস্ট্রেলিয়া খেলাপাগল দেশ। এত কম জনসংখ্যার একটি দেশ দুনিয়ার সব খেলায় আধিপত্য বজায় রাখে। এর কারণ, খেলাধুলার প্রতি মনোযোগ আর তার লালন-পালন। এ দেশের আইকন ডন ব্র্যাডম্যান। নাক উঁচু অজি কিংবদন্তি। ১৯৯৬ সালে তাঁর জন্মদিনে মাত্র দুজন খেলোয়াড়কে বাসভবনে ডেকেছিলেন তিনি। একজন ব্র্যাডম্যানের মতে, তাঁর মতো খেলে, যাঁর নাম শচীন টেন্ডুলকার। আরেকজন তাঁর সঙ্গী সেরা স্পিনার শেন ওয়ার্ন। বাকি সব তারকা হোটেল রুমে বসে আর এই দুজন ছিলেন অতিথি।
সিডনি তো বটেই, পুরো বিশ্বের ক্রীড়ামোদী মানুষের মন খারাপ করে দিয়ে বিদায় নিয়েছেন শেন ওয়ার্ন। যে কটি দেশ খেলে, তাদের ভেতরেই কয়েকজন হয়ে ওঠেন বিশ্বসেরা কিংবদন্তি। অস্ট্রেলিয়ার সমৃদ্ধ ক্রিকেট জগতের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার ছিলেন তিনি। তবে একটি বিষয়ে কেউ নেই তাঁর ধারে-কাছে। বিনোদন ও লাইফ লিভিং বলতে যা বোঝায়, তা শতভাগ করে গেছেন। যত দিন মাঠে ছিলেন, তত দিন মুখরোচক শিরোনাম। যখন মাঠের বাইরে, তখনো শিরোনাম। যখন ধারাভাষ্য দিতে প্রেসবক্সে, তখনো মজার মানুষ।
তিনি যখন ক্রিকেট থেকে অবসর নেন, তখন তাঁর নামের পাশে টেস্টে ৭০৮ উইকেট, যেটা তখনো পর্যন্ত সর্বোচ্চ। শুধু ৭০৮ উইকেট বা তাঁর একের পর এক বিষাক্ত লেগ স্পিনে বিপক্ষ ব্যাটারদের আউট হওয়া দিয়ে হয়তো ধরা যাবে না শেন ওয়ার্নকে। বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম বর্ণময় চরিত্র তিনি। রেকর্ডের খ্যাতির পাশে সেখানে সমান উজ্জ্বল যৌন কেলেঙ্কারি। কোনো কিছুই লুকিয়ে করেননি ওয়ার্ন। বুক চিতিয়ে, হাসিমুখে সবটা নিয়ে সামনে দাঁড়িয়েছেন। মাত্র ৫২ বছর বয়সে তাঁর চলে যাওয়ায় তাই হতবাক ক্রিকেট দুনিয়া। এখনো মেনে নিতে পারছেন না অনেকেই। হঠাৎ করে যেন শেষ হয়ে গেল ক্রিকেটের একটা অধ্যায়।
একটা মজার গল্প বলার লোভ সামলাতে পারছি না। আমার অনুজপ্রতিম সিডনিবাসী আহসান হাবিব তখন নিরাপত্তাসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানে কাজ করত। একবার তার কাজ পড়েছিল পাঁচ তারকা এক হোটেলে। তাঁর দায়িত্ব ছিল আগত অতিথিদের একটি রেজিস্টারে নাম লিখতে বলা। একদিন হাবিবের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন দুই অজি খ্যাতিমান মানুষ। একজন তখনকার মন্ত্রী, আরেকজন ক্রিকেটার শেন ওয়ার্ন। মিনিস্টার হাবিবকে অনুরোধ করলেন তাঁর নাম লিখতে। একটু থতমত খেয়ে যাওয়ায় মন্ত্রী তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, তুমি আমাকে চিনতে পারোনি? হাবিব মাথা নেড়ে জবাব দিয়েছিল: সরি, আমি তোমাকে চিনি না। নাম লেখা শেষে মন্ত্রী কিছুটা মজা আর ব্যঙ্গসহকারে হাবিবকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন: কবে এসেছ এই দেশে? আর কাকে চেনো তুমি?
হাবিব একটুও বিচলিত না হয়ে জবাব দিল, এই যে তোমার পেছনে দাঁড়ানো শেন ওয়ার্ন, তাঁকে চিনি। তিনি আমার হিরো। আমাদের দেশের সবাই চেনে তাঁকে। শেন ওয়ার্ন অজি স্টাইলে এক চোখ টিপে তাকে স্বাগত জানিয়ে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে ভেতরে ঢুকলেও বেরোনোর সময় আবার তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে ভোলেননি। এটাই ছিল তাঁর চরিত্র। সরল-সহজ ফান লাভিং এক স্পিন জাদুকর।
সত্যিকারের অজি লাইফ মেনে খাঁটি অস্ট্রেলিয়ান আমরা হতে পারব না, সম্ভবও না। যুগ যুগ ধরে বাস করে বা ক্যাঙারুর দেশে জন্ম নিলেও তা হবে না। এর সংস্কৃতি ও শিকড় যেখানে, সেখান থেকে শুরু করলে তাঁর মতো গাঁক-গাঁক করে অজি উচ্চারণে ইংরেজি বলা, অমন অঙ্গভঙ্গি করা, ইচ্ছেমতো বিয়ার পান করা এমনকি নেশা করাও জানা চাই বৈকি। এই যেমন একবার ভারত সফরে যাওয়ার সময় সবাই যখন বাক্সপেটরা নিয়ে ব্যস্ত, তখন তিনি ব্রেকফাস্টের জন্য অসংখ্য বিনসের কৌটা নিতে গিয়ে শিরোনাম হয়েছিলেন, ‘মি. বিন!’
আবার সেই মানুষটিই একসময় আইপিএলে রাজস্থান রয়্যালসের অধিনায়ক হয়ে শিরোপা এনে দিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম অধিনায়ক, যিনি আইপিএল জেতেন। প্রতিযোগিতার প্রথম বছরই রাজস্থান রয়্যালসকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন তিনি। যত মুখরোচক গল্পই থাকুক না কেন, শেন ছিলেন সেরার সেরা স্পিনার। ১৯৯৩ সালের আ্যশেজ সিরিজে তাঁর জাদুকরী স্পিনে আউট হন ইংল্যান্ডের মাইক গ্যাটিং। এই বলকে বলা হয় ‘বল অব দ্য সেঞ্চুরি’।
নারী, নেশা, উদ্দাম জীবনযাপন—সবকিছুর বাইরে এক বর্ণাঢ্য চরিত্র ছিলেন শেন। তাঁর জবানবন্দিতে সেরা দুই ব্যাটার শচীন ও লারা। এঁরাই তো তাঁরা, যাঁরা আমাদের যৌবন ও খেলার জগৎকে রাঙিয়ে রেখেছিলেন। এখনো রাঙিয়ে রাখেন বিদায় অস্তরাগে। ক্রিকেট কী, সেটাও পৃথিবীর অনেক মানুষ জানেন না, বোঝেনও না। কিন্তু তাঁদের অনেকে শেন ওয়ার্নের নাম জানেন।
শেন তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এসসিজি)। এই মাঠে খেলা দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাবে সোনালি চুল উড়িয়ে দৌড়ে আসা সেই কিংবদন্তি বোলারকে, যাঁর বলের ঘূর্ণি বুঝতে পারার আগেই উপড়ে নিত সেরা ব্যাটারের মিডেল স্টাম্প।
গত রাতে হঠাৎই তাঁর জীবনের খুঁটি উপড়ে নিয়েছে নিয়তি। থাইল্যান্ডে মারা গেছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা স্পিন জাদুকর।
গুডবাই মেট, গুড বাই শেন ওয়ার্ন। আওয়ার বিলাভড ওয়ার্নি...।