জানালা-কপাটহীন বিশাল হল ঘরের মধ্যে পিন পতন নীরবতা। সারি সারি নলাকার ধাতব ট্যাংকের মধ্যে শূন্যের নিচে ১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল নাইট্রোজেনে মাথা নিচের দিকে করে প্রচণ্ড ঠান্ডায় নিমজ্জিত আছে বহু মানুষের প্রাণহীন নিথর দেহ। ট্যাংকের বাইরে একটি ফলকে লেখা আছে মৃতের পরিচয়, নাম, জন্ম এবং মৃত্যুর তারিখ। মায়া-মমতা, ভালোবাসার পৃথিবী থেকে মৃত্যু নামক চরম বাস্তবতা তাঁদের প্রাণ ছিনিয়ে নিলেও মৃত্যুর কাছে হেরে যেতে তাঁরা নারাজ। একদিন খুব উন্নত বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির কল্যাণে আবারও ফিরে আসবেন চিরপরিচিত এই পৃথিবীতে। সে আশাতেই নিজেদের নশ্বর দেহ সংরক্ষণ করেছেন হিমায়িত আঁধারের আধারে।
মৃত্যু মানুষকে যতটা ভাবায়, আর কিছু তেমন করে মানুষকে উদ্বিগ্ন, বিষণ্ন করে না। অনেকেই এই নির্মম সত্য মোটেই মেনে নিতে পারে না এবং মৃত্যুকে ভয় পায়। ফেরাউনদের সময়ে, পরকালে দ্বিতীয় জীবন লাভের আশায় ফেরাউনদের মৃতদেহকে মমি করে রাখা হতো। আর একেশ্বরবাদী ধর্মে অনন্ত পরকালের প্রতিশ্রুতি আছে। বিভিন্ন লোককাহিনিতে বর্ণনা করা আছে দেবতারা অমর, মৃত্যু ও জরা তাদের স্পর্শ করে না। অমরত্ব তাই দেবগুণ। আবার দূর অতীতে কারও কারও হাজার বছর বা আরও বেশি বেঁচে থাকার কথা বলা হলেও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে তা মোটেই প্রমাণিত হয়নি।
প্রথম মানুষ যিনি নিজের দেহ সংরক্ষণের জন্য সব ব্যবস্থা আগে থেকে করে রেখেছিলেন, তিনি একজন মার্কিন নাগরিক। ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক, নাম জেমস হিরাম বেডফোর্ড (১৮৯৩-১৯৬৭)। তিনি মৃত্যুর পর থেকে আজও একটি ধাতব ট্যাংকে হিমায়িত তরল নাইট্রোজেনের মধ্যে অপেক্ষা করে আছেন, একদিন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তাঁকে আবারও পৃথিবীর বুকে সূর্যের আলো দেখার সুযোগ করে দেবে। পৃথিবীর বাতাসে আবারও আরেকবার বুক ভরে নিশ্বাস নেবেন।
এরপর ক্রায়োনিক্স কেন্দ্রে মাথা নিচের দিকে রেখে ধাতব ট্যাংকে শূন্যের নিচে ১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল নাইট্রোজেনে দেহটি ধীরে ধীরে ডুবানো হয়। ক্রমান্বয়ে মৃতদেহ হিমায়িত ও বায়ুরোধী করে ট্যাংকটি আটকে দেওয়া হয়। এখানেই মৃতদের থাকতে হবে অনির্দিষ্টকাল, সুদিনের অপেক্ষায়। আশা একটাই, একদিন জ্ঞান, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে উন্নত মানুষ এই মৃতদের হিমশীতল, নিকষ অন্ধকার আবাস থেকে বের করে আনবে। তাঁদের প্রাণহীন দেহে প্রাণের সঞ্চার করবে এবং তাঁদের দ্বিতীয় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবে।
ফ্রান্সসহ অনেকগুলো দেশে পুনর্জন্মের আশায় মৃতদেহ সংরক্ষণ নিষিদ্ধ। তবে মানুষের শুক্রাণু, ডিম্বাণু এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হিমায়িত করে সংরক্ষণ করা বৈধ। ২০১৬ সালে ১৪ বছরের এক ব্রিটিশ কিশোরী দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হলে নিজেই সরাসরি ব্রিটিশ বিচার বিভাগের কাছে আবেদন করে, যেন তাঁর মৃতদেহ সংরক্ষণের অনুমতি দেওয়া হয়। তাঁর আবেদন মঞ্জুর করা হয়।
লেখক: ফ্রান্স প্রবাসী গবেষক।