হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

ফাস্ট ফ্যাশন পরিবেশের কতটা ক্ষতি করছে

মৃত্যুঞ্জয় রায় 

সপ্তাহে ১ কোটি ১০ লাখ ফাস্ট ফ্যাশনের পোশাক দ্বারা শুধু যুক্তরাজ্যের মাটি ভরাট হচ্ছে। প্রতীকী ছবি: ফ্রিপিক

কয়েক দিন আগে গিয়েছিলাম ভিউজ বাংলাদেশ পত্রিকার প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। পাশে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা বসে ছিলেন। পরিচয় পেলাম তিনি বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) সিইও, নাম ফেরদৌস আরা বেগম। পরিচয়ের পর যখন তিনি জানতে পারলেন যে আমি পরিবেশ নিয়ে কাজ করি, তখন তিনি এক সমস্যার কথা তুলে ধরলেন, বললেন পরিবেশগত বিবেচনায় এর কোনো সমাধান জানা আছে কি না। কথা বলছিলেন আমাদের পোশাকশিল্প, পোশাক রপ্তানি ও ভবিষ্যতের শঙ্কা নিয়ে। তাঁর আশঙ্কা হলো, আমাদের দেশের পোশাক কারখানাগুলো এখন যেভাবে পোশাক তৈরি করছে ও বিদেশের বাজারে তা পাঠাচ্ছে, সেসব পোশাক আর ওইসব দেশ সেভাবে কিনতে চাইছে না। আমরা যে পোশাকগুলো তৈরি করি সেগুলোকে বলে ফাস্ট ফ্যাশন। ফাস্ট ফ্যাশন পোশাক অনেকটা ওয়ান টাইম ব্যবহারের মতো। এগুলো হয় খুব সস্তা ও নিম্ন বা সাধারণ মানের। ক্রেতারা সস্তা দামে সাময়িক ব্যবহারের জন্য কেনেন ও তা পুনর্ব্যবহারের কথা আর চিন্তাও করেন না। কেননা, তা করতে গেলে তাঁদের যে খরচ করতে হবে, তার চেয়ে কম দামে আরেকটা নতুন পোশাক কেনা যাবে। ফাস্ট ফ্যাশনের পোশাকগুলো তৈরি করতে খরচ লাগে কম, নকশা, তৈরি, বিপণন, পরিবহন সবই সহজে ও দ্রুত করা যায়। এসব কারণে ক্রেতারা খুব সহজে সস্তায় হাতের কাছে দ্রুত এসব পোশাক পেয়ে যান বলে ভূরি ভূরি কেনেন। ফাস্ট ফ্যাশনের পোশাকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো টি-শার্ট ও শার্ট, জিনস, গ্যাবার্ডিন প্যান্ট ইত্যাদি।

এটাই এখন পরিবেশ গবেষকদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অক্সফামের একদল গবেষক বলছেন, যুক্তরাজ্যে প্রতি মিনিটে যে পরিমাণ ফাস্ট ফ্যাশনের পোশাক কেনা হয়, তার কারণে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়, তা একটি গাড়ি চালিয়ে পৃথিবীকে ছয়বার প্রদক্ষিণ করার ফলে নিঃসরিত কার্বনের সমপরিমাণ। তাঁদের মতে, তৈরি পোশাক কারখানাগুলো বিশ্বে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করছে, তা জাহাজ ও উড়োজাহাজশিল্পের মোট কার্বন নিঃসরণের সমান। শুধু যুক্তরাজ্যেই প্রতি সপ্তাহে ১ কোটি ১০ লাখ ফাস্ট ফ্যাশনের পোশাক দ্বারা মাটি ভরাট করা হচ্ছে। অক্সফাম গবেষণায় আরও দেখতে পায় যে যুক্তরাজ্যে প্রতি মিনিটে ২ টনের বেশি তৈরি পোশাক কেনা হয়। একটি সাদা কটন শার্ট কেনার অর্থ হলো ৩৫ মাইল গাড়ি চালানোর সমপরিমাণ কার্বন নিঃসরণ ঘটানো। যুক্তরাজ্যে মাসে যে পরিমাণ ফাস্ট ফ্যাশনের পোশাক কেনা হয় তার কারণে নিঃসরিত কার্বনের পরিমাণ পৃথিবীকে ৯০০ বার উড়োজাহাজে চক্কর দেওয়ার ফলে নিঃসরিত কার্বনের সমান।

বিজনেস ইনসাইডার পত্রিকার এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে আরেক ভয়াবহ চিত্র, ফাস্ট ফ্যাশনের এক অন্ধকার দিক। সে পত্রিকায় বলা হয়েছে, বর্তমানে তৈরি পোশাক কারখানাগুলো মোট বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ১০ শতাংশ নিঃসরণের জন্য দায়ী। পোশাক তৈরির কারখানাগুলো একদিকে যেমন অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করে নদনদী ও জলাশয় শুকিয়ে ফেলছে, অন্যদিকে সেসব কারখানা থেকে নির্গত রংসহ বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্য নদ-নদী ও নালায় মিশে পানিকে দূষিত করছে। এতে জলজ জীবসহ সামগ্রিক পরিবেশের চরম ক্ষতি হচ্ছে। সাভার, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলের তৈরি পোশাক কারখানাগুলো থেকে নির্গত দূষিত পানি ও আশপাশের নদী, খাল ও বিলের অবস্থা দেখলেই তা আমরা ভালোভাবে বুঝতে পারব। শিল্প-কলকারখানা দ্বারা বিশ্বে জলাশয়দূষণের জন্য ৮৫ শতাংশ দায়ী তৈরি পোশাক কারখানাগুলো। এমনকি তৈরি পোশাক ধোয়ার কারণে প্রতিবছর প্রায় ৫ কোটি টন মাইক্রোফাইবার মিশছে সাগরের পানিতে, যা প্রায় ৫০ বিলিয়ন প্লাস্টিক বোতলের সমান।

কোয়ান্টিস ইন্টারন্যাশনাল ২০১৮ প্রতিবেদনে দেখা যায়, শিল্প-কারখানা দ্বারা বৈশ্বিক দূষণের জন্য মূলত তিনটি কাজ দায়ী—ডাইং ও ফিনিশিং ৩৬ শতাংশ, সুতা পৃথক্‌করণ ২৮ শতাংশ ও সুতা উৎপাদন ১৫ শতাংশ। সে প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে ফাস্ট ফ্যাশনের জন্য ব্যবহৃত সুতা উৎপাদনের জন্য তুলা চাষ করতে হচ্ছে। ব্যাপক জমি এ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা উৎপাদন করতে প্রচুর পরিমাণে স্বাদু পানি লাগছে। একদিকে সেচযন্ত্র ও কারখানা চালনার জন্য যেমন জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়ছে, অন্যদিকে পানির অতি ব্যবহারে সংকট বা অভাব তৈরি হচ্ছে, যা পৃথিবীর জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভাবতে অবাক লাগে যে কারখানায় একটিমাত্র কটন শার্ট তৈরি করতে ৭০০ গ্যালন ও একটি জিনসের প্যান্ট তৈরি করতে প্রায় ২০০০ গ্যালন পানি লাগে।

এ ছাড়া আরও অনেকভাবে তৈরি পোশাক কারখানা দ্বারা পরিবেশের দূষণ ঘটছে। পোশাক তৈরির জন্য যেসব কৃত্রিম সুতা ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো তৈরি করা হচ্ছে পলিয়েস্টার, নাইলন ও অ্যাক্রিলিক থেকে, যা পরিবেশে সম্পূর্ণ মিশে যেতে বা পচতে শতাধিক বছর সময় লাগে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংঘ বা আইইউসিএনের ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বে ব্যবহৃত সব মাইক্রোপ্লাস্টিকের ৩৫ শতাংশ অপচনশীল প্লাস্টিক কণা। এগুলো শেষে গিয়ে সাগরেই মেশে। এগুলো প্রধানত আসছে কৃত্রিম সুতা তৈরি ও তৈরি পোশাক কারখানা থেকে।

দিনদিনই সারা বিশ্বে ফাস্ট ফ্যাশনের পোশাক ব্যবহার বাড়ছে। বিশ্বে তৈরি পোশাকের উৎপাদন ছিল ২০০০ সালে ৫৮ মিলিয়ন টন, ২০২০ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১০৯ মিলিয়ন টন, ২০৩০ সালে তা দাঁড়াবে ১৪৫ টনে। বাংলাদেশ থেকে ২০২৩ সালে তৈরি পোশাক খাত থেকে আয় হয়েছিল ৪৭.৩৮ বিলিয়ন ডলার, যা সব রপ্তানি আয়ের ৮৪.৫৮ শতাংশ। এ দেশের পোশাক বেশি যায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয়। কথাবার্তার একপর্যায়ে ফেরদৌস আরা বেগম বলছিলেন, ইউরোপে একজন গড়ে বছরে প্রায় সাড়ে ৩৩ কেজি ফাস্ট ফ্যাশনের পোশাক কেনেন। আজ চার বন্ধু মিলে বাইরে লংড্রাইভে বা কনসার্টে যাব, চলো একই রকম চারটা টি-শার্ট কিনে ফেলি। এরপর ফিরে এসে কয়েক দিন পরে তা ভাগাড়ে ফেলো। এই হচ্ছে এখন ট্রেন্ড!

তাই ইউরোপীয় দেশগুলো এখন পরিবেশদূষণ কমাতে ফাস্ট ফ্যাশন পোশাকের ব্যবহার কমাতে চাইছে। এমনকি, পোশাক তৈরিতেও পরিবেশবান্ধব সামগ্রী ব্যবহারের ওপর জোর দিতে চাইছে। সেসব দেশে পোশাকের প্রবেশের সময় নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করতে চাইছে। যদি সেসব কড়াকড়িভাবে মানা হয়, তাহলে তৈরি পোশাকশিল্পে ধস নামতে পারে। তবে তাতে দিন শেষে লাভ হবে পরিবেশের।

মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

ভারতজুড়েই কি ফুটবে পদ্মফুল

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

সমুদ্রস্তরের উত্থান ও দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা

সংকটেও ভালো থাকুক বাংলাদেশ

মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা নিয়ে কথা

পাঠকের লেখা: বিজয় অর্জনের গৌরব

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি

অসময়েই শত্রু-মিত্র, মীরজাফর ও বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়

খেলা কি তবে এবার মুখ ও মুখোশের