সিটবেল্টটা ভালোভাবে বেঁধে নিন, সেই সঙ্গে রুদ্ধশ্বাস কিছু মুহূর্তের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখুন। কারণ পৃথিবীর বিপজ্জনক আটটি বিমানবন্দরের গল্প শোনাব আজ। আশপাশের ভূ-প্রকৃতি, আগে থেকেই গতি-প্রকৃতি বোঝা যায় না এমন আবহাওয়া, ছোট্ট রানওয়ে সবকিছু মিলিয়ে পাইলটদের দক্ষতার পরীক্ষা দিতে হয় এসব বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ ওঠানামার সময়।
তেনজিং-হিলারি বিমানবন্দর
নেপালের তেনজিং-হিলারি বা লুকালা বিমানবন্দরের অবস্থান সাগর সমতল থেকে ৯ হাজার ৩০০ ফুটের বেশি উচ্চতায়। এর রানওয়ে মাত্র ১ হাজার ৭২৯ ফুট। রানওয়ের এক পাশে পাহাড়ের পাথুরে দেয়াল। এই পার্বত্য অঞ্চলে আবহাওয়ার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই, তাই কেবল দিনেই উড়োজাহাজ ওঠা-নামা করে। হঠাৎ তুষার ঝড় কিংবা কুয়াশার কারণে ফ্লাইট বাতিল হওয়া এখানে খুব সাধারণ ঘটনা। এমনকি পরিস্থিত কখনো কখনো এমন খারাপ হয়ে যায় যে, কাঠমাণ্ডু ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয় পাইলটকে। ছোট উড়োজাহাজ আর হেলিকপ্টারই কেবল ওঠা-নামা করে এখানে। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে এখানে চারটি প্লেন ক্র্যাশের ঘটনা ঘটে। ২০১৯ সালে যেমন একটি উড়োজাহাজ রানওয়েতে গতি বদলিয়ে একটি হেলিকপ্টারে আঘাত করলে ৩ জন নিহত হন।
কিন্তু কথা হলো এত কিছুর পর এই বিমানবন্দরটির প্রতি মানুষের আগ্রহ আছে কেন এখনো? আসল ঘটনা হলো ৫০০ জনবসতির লুকালা মাউন্ট এভারেস্ট ট্র্যাকিং শুরুর একটি জনপ্রিয় জায়গা। শহরটিতে আপনি বাসে কিংবা হেঁটেও পৌঁছাতে পারবেন। তবে কাঠমাণ্ডু থেকে উড়োজাহাজে মাত্র ৪০ মিনিটে সেখানে পৌঁছানো সম্ভব হওয়ায় সময় বাঁচে। আর এভারেস্ট অভিযাত্রীরা সাহসী আর রোমাঞ্চপ্রেমী তা কে না জানেন!
ক্যারিবীয় দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের এই বিমানবন্দরটির অবস্থান একটি সাগর সৈকত লাগোয়া। এমনকি কোনো উড়োজাহাজ যখন বিমানবন্দরে নামতে থাকে সৈকতে থাকা পর্যটকেরা বাতাসের রীতিমতো একটা ঝাপটা অনুভব করেন। রানওয়ের দৈর্ঘ্য সাত হাজার ফুটের একটু বেশি। যার এক পাশে মাহো সৈকত, আরেক পাশে পর্বত। প্রায় মাথা ছুঁয়ে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজ আর শব্দের পরও সৈকতটি রোমাঞ্চপ্রেমীদের প্রিয় গন্তব্য। ১৯৪২ সালে মূলত সামরিক এয়ারস্ট্রিপ হিসেবে যাত্রা শুরু হলেও এখন সব ধরনের উড়োজাহাজ ওঠা-নামা করে।
ভুটানের পারো বিমানবন্দরের চারপাশে হিমালয়ের তুষার ছাওয়া সব শৃঙ্গ। এগুলোর কোনো কোনোটির উচ্চতা ১৮ হাজার ফুটের বেশি। দৃশ্যটা মন কেড়ে নেওয়ার মতো, একই সঙ্গে আবার এই পর্বতগুলোই বিমানবন্দরটিতে অবতরণ কঠিন করে তোলে পাইলটদের জন্য। গভীর উপত্যকায় অবস্থিত পারো বিমানবন্দর ভুটানের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কেবলমাত্র অল্প কিছু পাইলটেরই এখানে ওঠা-নামার লাইসেন্স আছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা উড়োজাহাজ ওঠা-নামা চলে এখানে। পাইলটদের এই বিমানবন্দরে অবতরণ বা উড্ডয়নের সময় উঁচু সব পর্বতের পাশাপাশি বাতাসের অপ্রত্যাশিত বিক্ষিপ্ত আচরণ, একমাত্র রানওয়েতে হঠাৎ খাঁড়া নামা বা ওঠা এমন বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। রানওয়েটিও কেবল সাড়ে ছয় হাজার ফুট লম্বা। বিমানবন্দরটির অবস্থানও সাগর সমতল থকে প্রায় ৭ হাজার ৩৬৪ ফুট উচ্চতায়। তবে যেসব পর্যটক পারো বিমানবন্দরে ওঠা-নামার সাহস করেন তাঁরা হিমালয় পর্বতমালার পাশাপাশি সবুজ উপত্যকার মাঝখান দিয়ে এঁকে-বেঁকে যাওয়া পারো নদীর সৌন্দর্যও উপভোগ করতে পারেন।
যুক্তরাজ্যের জিব্রাল্টার বিমানবন্দরে অবতরণের সময় একটি মনোলিথ কিংবা একশিলা স্তম্ভকে মুখোমুখি পাবেন। রানওয়েটি পাথরের খাঁড়া দেয়াল ও শহরের মাঝখানে। তবে শেষপ্রান্তে দুই পাশেই সাগর। কাজেই পাইলটদের থাকতে হয় খুব সতর্ক। তবে এই বিমানবন্দরের সবচেয়ে বড় চমকটি হলো রানওয়েটি চলে গেছে একটি ব্যস্ত সড়কের মাঝখান দিয়ে। বলা চলে এটাই একে এই তালিকায় স্থান করে দিয়েছে। কাজেই প্রতিবার কোনো উড়োজাহাজ ওঠার বা নামার সময় রাস্তাটি বন্ধ করে দিতে হয়।
স্কটল্যান্ডের প্রত্যন্ত দ্বীপ বাররায় পাবেন বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা একমাত্র বিচ বিমানবন্দরটিকে। ট্রায়াগ মোহরের সাদা বালুকাবেলায় ছড়িয়ে থাকা বিমানবন্দরটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বিমানবন্দরগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি রোমাঞ্চনুভূতি পুরো মাত্রায় উপভোগ করেন যাত্রীরা। এই বিমানবন্দরে অবতরণ ও উড্ডয়ন করা পাইলটদের আবহাওয়া পরিবর্তনের পাশাপাশি সাগরের জোয়ার-ভাটার দিকে খেয়াল রাখতে হয়। কারণ জোয়ারের সময় এখানকার তিনটি রানওয়ের পুরোপুরি পানির নিচে চলে যায়। বিমানবন্দরটি যখন চালু থাকে তখন অবতরণের জায়গা থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে দর্শনার্থীদের সতর্ক করে রাখা হয়।
পর্তুগালের মাদেরিয়া বিমানবন্দরটি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দর নামেও পরিচিত। একপাশে পাহাড়ের খাঢ়া দেয়াল ও আরেক পাশে সাগরের কারণে দক্ষ পাইলটদেরও দক্ষতার পরীক্ষা দিতে হয় এখানে ওঠা-নামায়। পরিস্থিতি জটিল করে তুলে আটলান্টিকের ঝড়ো বাতাস।
গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণ সীমায় অবস্থিত বিমানবন্দরটি বিপজ্জনক হওয়ার একাধিক কারণ আছে। পর্বতঘেরা সামুদ্রিক খাঁড়ি বা উপসাগরের মাঝখানে হওয়ায় ছবি তোলার জন্য জায়গাটি আদর্শ হলেও উড়োজাহাজ কিংবা বৈমানিকের বিবেচনায় বিষয়টি মোটেই আনন্দদায়ক নয়। খাঁড়ির ওপর দিয়ে ৬ হাজার ফুট লম্বা রানওয়ের দিকে যাওয়াটা বেশ কৌশলী, সেই সঙ্গে নব্বই ডিগ্রি একটা মোচড় নিতে হয় পাইলটকে। শক্তিশালী বাতাস চ্যালেঞ্জ বাড়ায়। তারপর আবার কাছেই থাকা আগ্নেয়গিরির ধোঁয়ায় দৃষ্টিসীমা কমিয়ে দেয়। এখানে কেবল দিনের বেলাতেই ওঠা-নামা করতে পারে উড়োজাহাজ।
ফ্রেঞ্চ আল্পসের রোমাঞ্চ অনুভব করার আগেই শরীরময় রোমাঞ্চকর একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে পর্যটকদের। এ জন্য ধন্যবাদ পেতে পারে কুরশেভেল বিমানবন্দর। সাগর সমতল থেকে ৬ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বিমানবন্দরে পৌঁছার আগেই একের পর এক পাহাড় ডিঙাতে হয় উড়োজাহাজকে। রানওয়েটি কেবল ১ হাজার ৭০০ ফুট লম্বা। বেশ খাড়াও, নিম্নমুখী ঢালের মাত্রা ১৮.৫ শতাংশ। সবকিছু মিলিয়ে এখানে উড্ডয়ন-অবতরণ তাই শ্বাসরুদ্ধকর।
সূত্র: ফডরস ডট কম, টাইমস অব ইন্ডিয়া