কয়েক সপ্তাহ পর পরই স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে হাজির হন হিসকান্দার জুলকারনাইন। তাঁদের গন্তব্য জুয়েল, টার্মিনাল ১–এর সঙ্গে যুক্ত শপিংমল। বিখ্যাত কানাডীয় স্থপতি মোশে সাফদি ও তাঁর সঙ্গীরা এর নকশা করেন। হিসকান্দার জুলকারনাইনের সন্তানদের এখানে সবচেয়ে পছন্দ সাত তলা উচ্চতার কৃত্রিম জলপ্রপাতটি। পৃথিবীর দীর্ঘতম ইনডোর জলপ্রপাত এটি।
ডিজনি থিমের আলোক শয্যার সঙ্গে গানের শোটাও তাদের প্রিয়। তারপর পরিবারটি যায় টার্মিনাল ৩ এ। শাটল বাস কিংবা ইলেকট্রিক ট্রেনে কয়েক মিনিটেই টার্মিনাল ১ থেকে সেখানে পৌঁছানো যায়। ছোটদের জন্য নানা ধরনের রাইড ও গেমের ব্যবস্থার আছে সেখানে।
‘আর কোনো বিমানবন্দরে এমন চমৎকার সময় কাটানোর, কেনাকাটা কিংবা খাওয়া–দাওয়ার ব্যবস্থা আমি দেখিনি,’ বিবিসিকে বলেন জুলকারনাইন, সিঙ্গাপুরের পৃথিবী বিখ্যাত শপিং এলাকা অরচার্ড রোডে যাওয়ার সময় চাঙ্গিতে সময় কাটানোটাও যিনি কিংবা তাঁর পরিবার সমান পছন্দ করেন।
পৃথিবীর ৫৫০ টির বেশি বিমানবন্দরের সুযোগ–সুবিধা ও সার্ভিস নিয়ে যাত্রীদের মতামতের ভিত্তিতে এই র্যাঙ্কিং করা হয় বলে জানায় স্কাইট্র্যাক্স। আশ্চর্যজনক হলেও এই ব্যাংকিংয়ে এখন পর্যন্ত ১২ বার সবার ওপরে থাকার কৃতিত্ব দেখিয়েছে চাঙ্গি বিমানবন্দর। এর মধ্যে গত দশকেই আটবার। গত মাস অর্থাৎ মার্চে পুনরায় সেরার খেতাবটি ফিরে পায় তারা, কাতারের দোহার হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও জাপানের টোকিওর হানেদা বিমানবন্দরকে পেছনে ফেলে।
তালিকায় চার ও পাঁচে আছে দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং ফ্রান্সের প্যারিসের শার্ল দ্যু গল বিমানবন্দর। ছয় ও সাতে তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর ও জার্মানির মিউনিখ বিমানবন্দর। সেরা দশের বাকি তিনটি স্থান দখল করেছে যথাক্রমে সুইজাল্যান্ডের জুরিখ বিমানবন্দর, জাপানের নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও স্পেনের মাদ্রিদ-বারাজাস বিমানবন্দর।
টুকিটাকি কেনাকাটা করতে ১৫ মিনিট গাড়ি চালিয়ে জুয়েল আসেন র্যাচেল ট্যান। ৩৪ বছর বয়স্ক এই আইনজীবী কেনাকাটার পাশাপাশি জায়গাটির আলাদা আকর্ষণ ক্ষমতার কথা ব্যাখ্যা করেন এভাবে, ‘ঝরনার পাশে বসতে পারেন আপনি, উপভোগ করতে পারেন সময়টি।’
পাতাল রেল কিংবা বাসে সহজেই পৌঁছানো সম্ভব চাঙ্গিতে, এমন মানুষ কিংবা পরিবারও পাবেন যারা গোটা দিনটিই চাঙ্গিতে কাটিয়ে দিয়েছেন। ছবি দেখতে পাবেন, খেতে পারেন, কেনাকাটা করতে পারেন এমনকি শান্ত একটি জায়গায় বসে পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিতে পারেন। এটি এখন ওয়েডিং ফটোগ্রাফি এবং রাতের খাবারে বন্ধু–বান্ধব বা পরিচিতদের সাক্ষাতের এক জায়গাও পরিণত হয়েছে।
বিমানবন্দরটির নিজস্ব একটি সুগন্ধিও আছে। গোটা চাঙ্গিতে এটি ছড়িয়ে দিচ্ছে তাঁর সুগন্ধ। টার্মিনাল ৪–এর ঠিক বাইরে যা দেখবেন তাও চোখ কপালে তুলবে, প্রমাণ আকারের সব ডাইনোসর দখল করে আছে এক মাইল এলাকা।
চাঙ্গি সিঙ্গাপুরের জনগণের কাছেও এক গর্বের জায়গা। সরকারের কাছেও আছে এর আলাদা গুরুত্ব। এমনকি করোনার সময় যখন বিমানবন্দরের চেক–ইন–কাউন্টার এবং ডিউটি ফ্রি দোকানগুলোও খাঁ খাঁ করছিল সিঙ্গাপুর সরকার প্রচণ্ডরকম আত্মবিশ্বাসী ছিল চাঙ্গি আবার পর্যটকদের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠবে সে বিষয়ে, প্রমাণ তখন অ্যাভিয়েশন খাতে তাঁদের এক শ কোটির বেশি সিঙ্গাপুরী ডলার ব্যায় শুরু করা।
চাঙ্গিকে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট কিংবা আমস্টারডামের শিফল বিমানবন্দরের চেয়ে অনেক বেশি সুপরিকল্পিত ও কার্যকর মনে করেন তিনি। ‘আমি সাধারণত ৬০ জনের মতো বড় দল নিয়ে যাতায়াত করি। কিন্তু কখনো মনে পড়ে না আমাদের একটি লাগেজ হারানো গেছে। পৃথিবীর অন্য বড় বিমানবন্দরগুলোতে কানেকটিং ফ্লাইট মিস করাটা খুব সাধারণ ব্যাপার, তবে এখানে তেমনটি ঘটে না।’ বলেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে কারিগরি কিছু সাধারণ জটিলতায় সড়ক কিংবা আকাশ পথে যাতায়াতের চেক পয়েন্টগুলোতে ইমিগ্রেশন পেরোতে বাড়তি সময় লেগে যায়। সে ক্ষেত্রে অনেক ভ্রমণকারী ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে চাঙ্গিকে বেছে নেন, এই বিশ্বাসে যে এখানে ভ্রমণপথে জটিলতায় পড়তে হবে কম। এ মতামত, অ্যাভিয়েশন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এনডাও এনালিটিকসের শোকর ইউসুফ।
বিমানবন্দরটির এই আবেদন অটুট আছে পুরোপুরি। ২০১৯ সালে ফিরে যাই, উদ্বোধনের প্রথম ছয় মাসে ৫ কোটি মানুষের আগমন ঘটে জুয়েলে। পঞ্চম একটি টার্মিনালের কাজ শুরু হয়েছে, ২০৩০–এর দশকের মাঝামাঝিতে এটি উন্মুক্ত করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
‘আমার মনে হয় না পৃথিবীর আর কোনো বিমানবন্দরের বেলায় এমনটা ঘটে, যেখানে স্থানীয়রা শুধু সময় কাটাতে আসেন,’ বলেন আইনজীবী আদ্রিয়ান ট্যান। তাঁর ধারণা সিঙ্গাপুরবাসীর কাছে এটি পাড়ার একটি কফি শপের মতোই পরিচিত। শুধু তাই নয়, আদ্রিয়ানের মতে সিঙ্গাপুরের ভালো যা কিছু সবকিছুই তুলে ধরে বিমানবন্দরটি। যেমন সিঙ্গাপুরীদের দক্ষতা, সৌজন্যের প্রকাশ ঘটে চাঙ্গিতেও।
আরও খবর পড়ুন: