গরম কমার কোনো লক্ষণই নেই। ঘর থেকে বের হলেই রোদের তাপে শরীর ঝলসে যায় বলে মনে হচ্ছে। ঘরেও রেহাই নেই, বনবন করে ঘুরতে থাকা বৈদ্যুতিক পাখার বাতাসটাও যে গরম। গত কয়েক দিনের ধারাবাহিকতায় গতকাল মঙ্গলবারও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায়, ৩৯.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পাঠকদেরও কিছুটা সান্ত্বনা দিতে গতকাল পৃথিবীর বেশি গরম পড়ে এমন ১০টি জায়গার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম, যেসব জায়গায় তাপমাত্রা আমাদের দেশের বিভিন্ন শহরের থেকে অনেক বেশি থাকে। এই তালিকায় প্রথম ছিল মার্কিন মুল্লুকের ডেথ ভ্যালির নাম। অনেকের মতেই পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ জায়গা এটি। আজ সেখানে বাস করা মানুষের জীবন কীভাবে কাটে তা-ই জানাব। আশা করা যায়, এই লেখা পড়ার পর কিছুটা স্বস্তি পাবেন এই ভেবে, সেখানে থাকতে হচ্ছে না আপনাকে!
তিন শতাধিক মানুষের বাস আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালিতে। আগস্টে দিনে এখানকার গড় তাপমাত্রা থাকে ১২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৪৮.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। যে কোনো বিচারেই জায়গাটিকে বিবেচনা করা যায় পৃথিবীর উষ্ণতম জায়গাগুলোর একটি হিসেবে। এখানকার অধিবাসীদের বেশির ভাগ ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের কর্মকর্তা–কর্মচারী কিংবা স্থানীয় হোটেলের কর্মী।
রেকর্ড হোক বা না হোক, জুলাই আর আগস্টের বেশির ভাগ দিনে আপনার মনে হবে ওভেনের ভেতর দিয়ে হাঁটছেন। এটি আমার কথা নয়, সেখানকার ফার্নেস ক্রিকের বাসিন্দা ও ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের পাবলিক ইনফরমেশন অফিসার ব্র্যান্ডি স্টুয়ার্টের। ‘আপনি বাইরে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই টের পাবেন এটি। আপনার ত্বক এটা জানান দেবে, তবে ঘামের উপস্থিতি অনুভব করবেন না। কারণ, এটা বাষ্পীভূত হয়ে যায় দ্রুত।’ বলেন তিনি।
ডেথ ভ্যালিতে সারা বছর থাকা ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষের আগস্টজুড়ে দিনে ১১০ থেকে ১২৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রাতেই সব কাজ করতে হয়। রাতে অবশ্য তাপমাত্রা ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের (৩২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস) আশপাশে থাকে। তবে এই আগুনে গরমেই এখানকার বাসিন্দারা কাজ করেন, সামাজিক যোগাযোগ বজায় এমনকি বাইরে ব্যায়াম কিংবা শরীরচর্চাও করেন।
টেইলর জানান, তাঁর মোটামুটি এক বছর লেগেছে এখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে। অন্যদের বেলায়ও মোটামুটি একই ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা।
তবে একটা ভালো দিক হচ্ছে, এখানকার তাপটা শুষ্ক। মানে, ঘাম দ্রুত বাষ্পীভূত হয়। শরীরটা এভাবে দ্রুত শীতল হয়।
কাছাকাছি থাকা
কাউ ক্রিক, টিমবিশা শশন ভিলেজ আর স্টোভপাইপ ওয়েলসে ডেথ ভ্যালিতে বছরজুড়ে থাকা মানুষদের বেশিরভাগের বাস। কাছের শহরে গাড়িতে এক ঘণ্টার যাত্রা। এখানকার কিছু কিছু শিশু এক ঘণ্টা বাস ভ্রমণ করে স্কুলে যায়। অবশ্য টেইলর ও তাঁর স্ত্রী বাড়িতেই তাঁদের পাঁচ মেয়েকে পড়ালেখা করান।
কাউ ক্রিক কমপ্লেক্সে ৮০টির মতো হাউজিং ইউনিট আছে। বেশির ভাগই একটি থেকে আরেকটি হাঁটা দূরত্বে। এখানে জিম, খেলার জায়গা এমনকি পাঠাগারও আছে। বেশির ভাগ বাড়িতেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের দুই ধরনের ব্যবস্থা আছে। একটি সাধারণ এসি ইউনিট। অপরটি সোয়াম্প বা এভাপোরেটিভ কুলার, যেটি শুকনো, উষ্ণ বাতাসকে শীতল করে।
তবে সব বাসিন্দাই যে দুই ধরনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ব্যবহার করেন তা নয়। এমনকি একটিও ব্যবহার করেন না কেউ কেউ।
‘কেউ কেউ এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার করেন না।’ বলেন টেইলর। তিনি জানান, মূলত অর্থ সাশ্রয়েই এটা করেন তাঁরা। টেইলর আরও বলেন, এখানে সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকে। ন্যাশনাল পার্কের মোটামুটি ১৫০ জন চাকরিজীবী বুক ক্লাব, ক্রাফটিং ক্লাবসহ নানা সংগঠনের মাধ্যমে মিলেমিশে থাকেন।
শুনে চমকাবেন, এমনকি জুলাইয়েও ডেথ ভ্যালির বাসিন্দারা বাইরে দৌড়ান। ‘আমরা এখানে ঘুরতে আসা কাউকে গ্রীষ্মে বাইরে দৌড়ানোর পরামর্শ দেব না কখনোই।’ বলেন টেইলর, ‘তবে আপনি যদি প্রতিদিন দৌড়ান, তাহলে ১১৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার সঙ্গেও মানিয়ে নেবে।’
টেইলর ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা বাড়তি স্যাটেলাইট ফোন ছাড়া বের হন না। স্টুয়ার্ট কখনো বয়ফ্রেন্ড ও পানিভর্তি বড় একটি জগ ছাড়া মুদি দোকানে যান না। নিয়মিতই গাড়িটার দিকে নজর থাকে তাঁর। পাছে চাকা ফেঁসে গিয়ে দুর্গম জায়গায় অসহায় অবস্থায় আটকা পড়তে হয়।
বড় বিপদ জলবায়ু পরিবর্তন
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে ডেথ ভ্যালির বাসিন্দাদের ওপরও। গত ২০ বছর ডেথ ভ্যালির ইতিহাসের সবচেয়ে ১০টি মাসের মধ্যে ছয়টি রেকর্ড করা হয়েছে।
মজার ঘটনা, ডেথ ভ্যালিতে একটি গলফ কোর্স বা গলফ মাঠও আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিম্নতম গলফ মাঠ এটা, সাগর সমতল থেকে যার অবস্থান ২১৪ ফুট নিচে।
সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
ডেথ ভ্যালির ফার্নেস ক্রিকের দখলে বায়ুর উষ্ণতম তাপমাত্রার রেকর্ডটি। এই মরু উপত্যকায় ১৯১৩ সালের গ্রীষ্মে তাপমাত্রা পৌঁছায় ৫৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তবে কিছু কারণে ওই রেকর্ড নিয়েও সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
রেকর্ড বুকে থাকার পরও ওটাকে যদি গণনায় না-ও ধরেন, তার পরও গ্রহণযোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া উচ্চ তাপমাত্রার রিডিংগুলোর মধ্যে সবার ওপরে ফার্নেস ক্রিকই। ২০২০-এর আগস্টে এখানে তাপমাত্রা পৌঁছায় ৫৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। বুঝুন, এখানে অবলীলায় বছরের পর বছর ধরে বাস করছে ৩০০-৪০০ মানুষ! আর এটা চিন্তা করে মাথার ওপর আগুন ঢালা সূর্যটাকে রেখে, কিংবা ঘরের ভেতরের অসহ্য গরমের পরও একটু তৃপ্তির ঢেকুর তো তুলতেই পারেন, যাক ডেথ ভ্যালিতে অন্তত থাকতে হচ্ছে না।
সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার, বিবিসি
আরও খবর পড়ুন: