শুনে অবাক হবেন, ভারতের মতো জনবহুল দেশের কোনো কোনো শহর ধুঁকছে জনসংখ্যা সংকটে। এসব জায়গায় জন্মহার যেমন কম, তেমনি অনেকেই শহর ছেড়েছেন উন্নত জীবনের আশায়। অনেকটা মৃত শহর বা ঘোস্ট টাউনে পরিণত হয়েছে এগুলো, যেখানে বাস মূলত বয়স্কদের। এমনই এক জায়গা কেরালার কুমবানাদ। সেখানে গিয়েছিলেন বিবিসির সৌতিক বিশ্বাস।
বিগত বছরগুলোতে কেরালার এই অলস শহরের স্কুলগুলো অস্বাভাবিক এক সমস্যায় ভুগছে। শিক্ষার্থী বড় দুষ্প্রাপ্য এখানে, তাদের খোঁজে বের হতে হয় শিক্ষকদের। শুধু তাই নয়, স্কুলে ছাত্রছাত্রী আনতে গাঁটের পয়সা খরচ করতে হয় তাঁদের।
১৫০ বছর আগে স্থাপিত কুমবানাদের সরকারি আপার প্রাইমারি স্কুলে এখন শিক্ষার্থী আছে কেবল টেনেটুনে ৫০ জন। ১৯৮০ সালের দিকে সংখ্যাটা ছিল ৭০০। এই শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই আবার দরিদ্র পরিবারের, যাদের শহরের প্রান্তে অবস্থান। এর মধ্যে সর্বোচ্চ শ্রেণি গ্রেড সেভেনের শিক্ষার্থী কেবল সাতজন। শুধু তাই নয়, শিক্ষকদের এই শিক্ষার্থীদের স্কুলে আসা-যাওয়ার ভাড়াও গুনতে হয়। এমনকি এখানে যে কয়েকটি বেসরকারি স্কুল আছে, তার শিক্ষকদেরও শিক্ষার্থীর খোঁজে বের হতে হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রী আছে যে স্কুলে, সেটির শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ৭০।
কথাটা মোটেই মিথ্যা নয়। কুমবানাদ শহরটির অবস্থান কেরালার পাথানামথিতা জেলার ঠিক কেন্দ্রে। এখানে জনসংখ্যা যেমন কমছে, তেমনি যারা বাস করছেন তাঁদের বেশির ভাগই বয়স্ক।
কুমবানাদ ও আশপাশের আধা ডজন গ্রামে মোটামুটি হাজার পঁচিশেক মানুষের বাস। এখানকার ১১ হাজার ১১৮পি বাড়ির শতকরা ১৫ শতাংশ বাড়িতে ঝুলছে তালা। এসব বাড়ির বাসিন্দারা অন্য কোথাও চলে গেছেন কিংবা ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। জানান স্থানীয় গ্রাম কাউন্সিল প্রধান আশা সি জে।
ভারতে এক যুগের জনসংখ্যা বৃদ্ধির শেষ যে জরিপ (২০০১-১১) করা হয়, তাতে তলানিতে ছিল কেরালা ও তার প্রতিবেশী রাজ্য তামিলনাড়ু। জাতীয় গড় আয়ু ৬৯ হলেও কেরালায় জন্মগ্রহণকারী শিশু ৭৫ বছর আয়ুর আশা করতে পারে।
আন্নাম্মা জেকব তাঁর দোতলা বাড়িতে একাকী জীবন কাটাচ্ছেন কয়েক দশক ধরে। ৭৪ বছরের অন্নাম্মার স্মৃতিতে কেবল নিঃসঙ্গতা। তাঁর যন্ত্রকৌশল প্রকৌশলী স্বামী ১৯৮০-র দশকেই মারা যান। তাঁর পঞ্চাশে পা দেওয়া ছেলে দুই দশকের বেশি সময় ধরে আবুধাবিতে বাস ও কাজ করছেন। অন্নাম্মার এক মেয়ে থাকেন কয়েক মাইলের মধ্যে, তবে তাঁর স্বামী দুবাইয়ে সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করছেন তিন যুগ ধরে।
আন্নাম্মার নিকটতম দুই প্রতিবেশীর একজন বাড়িতে তালা দিয়ে মা-বাবাকে নিয়ে গেছে বাহরাইনে, সেখানে নার্সের কাজ করেন তিনি। অপর প্রতিবেশী দুবাই চলে গেছেন, বাড়িটা ভাড়া দিয়েছেন এক বৃদ্ধ দম্পতিকে।
‘এটা খুব নিঃসঙ্গ এক জীবন। আমার শরীরও ভালো থাকে না।’ বলেন আন্নাম্মা জেকব। তবে হার্টে সমস্যা ও বাত থাকার পরও ছেলে ও নাতিদের সঙ্গে সময় কাটাতে বিদেশে পাড়ি জমান তিনি।
আন্নাম্মার বাড়ি থেকে কয়েক লেন দূরে চাক্কো মাম্মেন তাঁর কলার খামারে দিনে চার ঘণ্টা শ্রম দেন। তাঁরও হার্টের সমস্যা আছে, সঙ্গে ডায়াবেটিস। ৬৪ বছরের চাক্কো তিন দশক ওমানে কাজ করে পরে দেশে ফিরে আসেন।
পুলিশ একাকী থাকা এই বৃদ্ধদের খোঁজ-খবর নেয় নিয়মিত। তবে এখানে অপরাধের হার কম। পুলিশ জানায়, চুরির ঘটনা এখানে একেবারেই কম, কারণ মানুষ ঘরে বেশি টাকা বা মূল্যবান জিনিস রাখে না। শেষ কবে এখানে খুনের ঘটনা ঘটেছে তাও মনে করতে পারেন না তাঁরা।
শহরে অপরাধ কম হওয়ায় পুলিশ বয়স্ক ব্যক্তিদের দেখভালে বেশি সময় দিতে পারে। ২০২০ সালে একটি বাড়িতে বারবার বেল চেপে সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে পুলিশ। দেখতে পায়, ওই বাড়ির বাসিন্দায় এক বয়স্ক নারী মাটিতে পড়ে আছেন।
‘আমরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে সুস্থ হন তিনি। আমাদের আরেকটি কর্তব্য শহরের বাসিন্দাদের বৃদ্ধনিবাস বা ওল্ড হোমে নিয়ে যাওয়া। আমরা নিয়মিত বয়স্কদের খবর নিই, তাঁদের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাই।’ বলেন চিফ ইন্সপেক্টর কুমার।
শহরে হুইলচেয়ারে পৌঁছা যায় এমন তিনটি ওল্ড হোম আছে। এগুলো বেশ খোলামেলা, দরজা ও হলওয়ে প্রশস্ত। এদের একটি পাঁচতলা দালানের দ্য আলেক্সান্ডার মারথোমা মেমোরিয়াল জেরিয়াট্রিক সেন্টার। এর সঙ্গেই আছে ১৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল। এই বৃদ্ধনিবাসে ৮৫ থেকে ১০১ বছর বয়সী ১০০ জন বৃদ্ধের দেখভাল করা হয়। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগ শয্যাশায়ী, পরিবারকে মাসে ৫০ হাজার রুপি করে গুনতে হয় এই সেবার বিনিময়ে। কখনো ছেলেমেয়েরা এসে থাকেন তাঁদের সঙ্গে।
এর কাছেই ৭৫ বছরের পুরোনো ধর্মগিরি ওল্ড এজ হোম। সেখানে ৬০ জন স্থানীয় বাসিন্দার বাস, যাদের প্রত্যেকের বয়স ৬০-র বেশি।
অসুস্থ বয়স্ক মানুষ, বৃদ্ধনিবাস, শ্রমিক সংকট, তরুণদের অভিবাসন, জনসংখ্যা হ্রাস, মৃতপ্রায় শহর—এই সবকিছুই যেন এখন কুমবানাদের চিত্র।
‘জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পরিবর্তনের এক গল্প এই শহর। শেষ পর্যন্ত গোটা ভারতের গল্প হবে এটি।’ বলেন মুম্বাইভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন সায়েন্সের অধ্যাপক কে এস জেমস।
বিবিসি থেকে অনুবাদ ইশতিয়াক হাসান
আরও খবর পড়ুন: