নাটোরের সিংড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী দেলোয়ার হোসেনকে তুলে নিয়ে ব্যাপক মারধর করা হয়েছে। দেলোয়ার ও তাঁর ভাইসহ তিনজনকে তুলে নিয়ে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সাধারণ সম্পাদক মোহন আলীর বিরুদ্ধে।
ভুক্তভোগী প্রার্থীর বর্ণনা অনুযায়ী, আজ সোমবার মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর জেলা নির্বাচন অফিসের সামনে থেকে দেলোয়ার ও তাঁর কর্মীদের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান মোহন। পরে তাঁদের শহরের অদূরে সড়কের পাশে ফেলে রেখে যান তাঁরা। গুরুতর অবস্থায় দেলোয়ারকে উদ্ধার করে প্রথমে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসকের পরামর্শ তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
আজ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল। সকালে হঠাৎ করেই মনোনয়ন জমা দেন দেলোয়ার। এর আগে গতকাল রোববার পর্যন্ত মনোনয়ন জমা দেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লুৎফুল হাবিব রুবেল। রুবেল ডাক, টেলিযোগাযোগ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালক। অপহরণ ও মারধরে অভিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহন রুবেলের অনুসারী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সকালে অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের জন্য দেলোয়ার নাটোর শহরে আসেন। এ সময় তাঁর বড় ভাই ও কলম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক এবং কলম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন মুন্সি ব্যাংকে জামানতের টাকা জমা দেওয়ার জন্য তাঁকে শহরে রেখে বের হন। তাঁরা কোড নম্বর জানার জন্য নাটোর জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের সামনে এলে কালো মাইক্রোবাসে করে কয়েকজন যুবক তাঁদের পথরোধ করেন। একপর্যায়ে তাঁদের জোর করে ওই মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান। এরপর থেকে তাঁদের ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে এসে দেলোয়ার ঘটনা জানতে পারেন এবং ৯৯৯ নম্বরে ফোনকল করে ঘটনাটি জানান।
বিকেলে দেলোয়ার তাঁর কর্মীদের নিয়ে জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে যান মনোনয়নপত্রের প্রতিলিপি জমা দিতে। জমা দেওয়ার পর অফিস থেকে বের হলে একটি মাইক্রোবাসে কয়েকজন যুবক জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে গেট থেকে তাঁকে কিলঘুষি মারতে মারতে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান। ঘটনাটি ডিসি অফিস ও কোর্ট এলাকা সংলগ্ন হওয়ায় অনেক মানুষ দেখেছে।
কলম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন মুন্সি আজ রাতে এ ব্যাপারে বলেন, তাঁদের কেউ তুলে নিয়ে যায়নি। তাঁরা যথাসময়ে মনোনয়ন জমাদানের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বাড়ি ফিরেছেন। বিকেলে দেলোয়ারকে অপহরণের ঘটনা তাঁর জানা নেই। তাই কোনো মামলা বা অভিযোগ দেবেন না।
আজ রাত রাত ৯টার দিকে দেলোয়ারকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়ার একটি ছবি আজকের পত্রিকার হাতে এসেছে। ছবিতে বেশ কয়েকজন মিলে একজনকে ধরাধরি করে মাইক্রোবাসে তোলার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।
উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি হাসান ইমাম জানান, তাঁর সংগঠনের কেউ কাউকে অপহরণের সঙ্গে জড়িত নন। সাধারণ সম্পাদক মোহন এ রকম কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন।
এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত মোহন আলীকে একাধিকবার ফোনকল করা হলে তিনিও রিসিভ করেননি।
পরে রাত সাড়ে ৯টায় দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, মনোনয়ন দাখিলের কারণে তাঁকে তুলে নিয়ে মারধর করা হয়েছে। যারা মেরেছে তারা প্রতিমন্ত্রীর শ্যালক রুবেলের লোক। তাদের কারণে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
তবে দেলোয়ারের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী লুৎফুল হাবিব রুবেল বলেছেন, তিনি মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। কাউকে তুলে নেওয়ার ঘটনা তিনি জানেন না। পারিবারিক কোনো বিরোধে এমন ঘটতে পারে বলে তাঁর ধারণা।
রাজশাহীতে আজকের পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, দেলোয়ার কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। অচেতনের মতো পড়ে আছেন। ওয়ার্ডের চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে আইসিইউ লিখে দিয়েছেন। তাঁর সিরিয়াল নম্বর ১২। রাত পৌনে ১০টা পর্যন্ত তাঁর স্বজনেরা ওয়ার্ডে অপেক্ষা করছিলেন। সিটি স্ক্যান করানোরও প্রস্তুতি চলছিল।
দেলোয়ারকে হাসপাতালে এনেছেন তাঁর ভাই এমদাদুল হক ও চাচাতো ভাই আসের উদ্দিন। তাঁরা জানান, দেলোয়ারকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর ব্যাপক মারধর করা হয়েছে। এরপর একটি মাইক্রোবাসে তুলে দেওয়া হয়েছে। সেই মাইক্রোবাস দেলোয়ারকে বাড়িতে নিয়ে গেছে। এরপর ওই মাইক্রোবাসে করেই তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়েছে।
ট্রলিতে শুয়ে থাকা অবস্থায় দেলোয়ারের মুখ, বুক, চোখ, পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে।
ঘটনার ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটেছেন জেলা পুলিশ কর্মকর্তারা। কীভাবে এবং কোথা থেকে দেলোয়ারকে উদ্ধার করা হলো তা জানতে আজ সোমবার রাতে একাধিকবার জেলা পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম ও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমানকে ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে কল করা হলেও তাঁরা সাড়া দেননি।
জেলা নির্বাচন অফিসার আব্দুল লতিফ শেখ জানান, প্রার্থী দেলোয়ার হোসেনের মনোনয়ন সময়মতো জমা হয়েছে। তাঁর তথ্য নির্বাচন কমিশনেও পাঠানো হয়েছে।