ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা রাজেদাকে ফেলে স্বামী শাহিন হোসেন দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। সংসারে নিজের বৃদ্ধ মা আর অনাগত শিশুর ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজমিস্ত্রির জোগালি হিসেবে কাজ শুরু করেন রাজেদা। তারপর কেটে গেছে ২৩টি বছর। নির্মাণকাজের জোগালি দেওয়া সেই রাজেদা এখন ‘হেডমিস্ত্রি’।
সংগ্রামী রাজেদা বেগমের (৪১) বাড়ি নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার মশিন্দা ইউনিয়নের কান্দিপাড়া গ্রামে।
রাজেদা বেগম জানান, মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। বিয়ের দুই বছর পর তিনি যখন ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, তখন তাঁকে ছেড়ে স্বামী শাহিন হোসেন দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে যান। সন্তান জন্মের পর শিশুকে বড় করে তুলতে আর বৃদ্ধ মায়ের মুখে খাবার তুলে দিতে রাজমিস্ত্রির শ্রমিকের কাজ শুরু করেন রাজেদা।
তখন অবশ্য এই কাজটি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না তিনি। প্রতিবেশী একজন শ্রমিক তাঁকে এই জোগালির কাজটি জুটিয়ে দেন। নির্মাণাধীন ভবনগুলোয় কাজ করতে গিয়ে অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে রাজেদাও ইট, বালি ও সিমেন্ট এগিয়ে দিতে শুরু করেন। দীর্ঘ ১০ বছর পর জোগালি থেকে হেডমিস্ত্রি হন তিনি। এখন তাঁর সঙ্গে ১০-১২ জন শ্রমিক কাজ করছেন বলে জানান রাজেদা বেগম।
একজন নারী শ্রমিক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা শুরুর দিকে কেমন ছিল জানতে চাইলে রাজেদা জানান, তখন বয়স তাঁর আঠারোর কোঠায়, সবে সংসার ভেঙেছে। তাঁর মতো একজন নারীর জন্য ঘর ছেড়ে গ্রামে-শহরে গিয়ে পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করার বিষয়টি সহজ ছিল না। কর্মক্ষেত্রে কিংবা চলতি পথে অনেকে নানা রকম নেতিবাচক মন্তব্য ছুড়ে দিত। অনেকে আবার ইশারা-ইঙ্গিতে অনৈতিক প্রস্তাবও দিত। এসব নিয়ে বৃদ্ধ মা ও বড় ভাইদের অনেক কথাও তাঁকে শুনতে হয়েছে। কিন্তু নিজের মা আর সন্তানের মুখ মনে করে সব কটুকথা চুপ করে শোনে গেছেন, কিন্তু পথচলা থামাননি।
রাজেদা জানান, সন্তান জন্মের পর ২৫ টাকা দৈনিক হাজিরাতে জোগালি হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। ১০ বছর খেয়ে না-খেয়ে অনেক কষ্টে দিন কেটেছে তাঁরা। ১২ বছর ধরে হেডমিস্ত্রি হিসেবে কাজ শুরু করায় এখন তাঁর দৈনিক মজুরি এখন ৫০০ টাকা। উপার্জনের টাকায় টেনেটুনে সংসার চলছে। এরই মধ্যে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের সংসারে দুই ছেলে, এক মেয়ে রয়েছে। জামাতার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তাঁদেরও দেখতে হয়।
সমাজে নারীদের বিষয়ে রাজেদা মনে করেন, নিজের অবস্থান ঠিক রেখে, নিন্দুকের কথায় কান না দিয়ে মানসিক শক্তি ও সাহস নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। যোগ্যতা অনুযায়ী আত্মমর্যাদার সঙ্গে কাজ করে নিজ পায়ে দাঁড়াতে হবে।
রাজেদার বৃদ্ধ মা আমেনা বেগম জানান, অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু স্বামীর ঘর করতে পারেননি। মেয়েকে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য অনেক চাপ দেওয়া হলেও সন্তানের কথা ভেবে তাঁর মেয়ে তাতে রাজি হননি।
উপজেলা রাজমিস্ত্রি শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি জয়েন উদ্দিন বলেন, রাজেদা বেগম উপজেলার মধ্যে একমাত্র নারী শ্রমিক। সততা আর পরিশ্রমের কারণে জোগালি থেকে হেডমিস্ত্রি হয়ে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁকে ঘিরে নেতিবাচক কোনো অভিযোগ নেই।