জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল নেতা মো. জোবায়েদ হোসেন হত্যাকাণ্ড নিয়ে পুলিশ ‘ত্রিভুজ প্রেমের গল্প’ বলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. রইছ উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সংবাদ সম্মেলন থেকে ত্রিভুজ প্রেমের গল্পের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জোবায়েদের সম্পর্কে তার শিক্ষক ও সহপাঠীরা যতটুকু জানে, তাতে এই ধরনের মন্তব্য তার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়। তা ছাড়া জোবায়েদ যদি প্রেমই করত, তাহলে তো তাকে আর মেয়ের পরিবার টিউশনিতেই রাখত না।’
বুধবার (২২ অক্টোবর) রাত সাড়ে ৯টার দিকে আজকের পত্রিকাকে এসব কথা বলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. রইছ উদ্দীন। এর আগে বিকেলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির আয়োজনে ভাষাশহীদ রফিক ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির সংবাদ সম্মেলনের নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন, প্রক্টর, বিভাগীয় প্রধান, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ছাত্রদল ও অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মী এবং জোবায়েদের আইনজীবী মো. ইশতিয়াক হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
ঘটনার দ্বিতীয় দিনে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁরা হলেন বার্জিস শাবনাম বর্ষা (১৮), মাহির রহমান (১৯) ও ফারদীন আহম্মেদ আয়লান (২০)। এরপর মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো নজরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বর্ষাকে পড়াতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে জোবায়েদের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে বর্ষার সঙ্গে মাহিরের পূর্ববর্তী সম্পর্ক ছিল। এটা মূলত ‘ত্রিভুজ প্রেমের গল্প’। এর জেরে মাহির ও আয়লান মিলে বর্ষার সহযোগিতায় হত্যা করেন জোবায়েদকে।
পুলিশের এই বক্তব্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক রইছ উদ্দীন বলেন, ‘আমাদের কিছু কিছু বিষয় নিয়ে সংশয় আছে, প্রশ্ন আছে। জোবায়েদকে হত্যার আগে তার ছাত্রী বর্ষা তাকে কল দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, সে কখন আসতেছে, কতটুকু এসেছে এবং তার আসার বিষয়টি নিশ্চিত হয়, পরে তার লোকেশন চেক করে। বিষয়টা স্বীকারোক্তি দিয়েছিল ছাত্রী বর্ষা। সেটি এজাহারের প্রথম সূত্র হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি কেন বাদ দেওয়া হলো? সেটা কি ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে, নাকি পরে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেটা আমাদের প্রথম প্রশ্ন।’
ডিএমপির বক্তব্য অনুযায়ী, মাহিরকে বর্ষা বলেছিলেন, জোবায়েদকে না সরালে তিনি ‘মাহিরের হতে পারবেন না’। এরপর এক মাস আগে জোবায়েদকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
পুলিশের দেওয়া ঘটনার বর্ণনা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রইছ উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘জোবায়েদকে আক্রোশে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা জানি, আক্রোশে হত্যা করলে এলোপাতাড়ি আঘাত করা হয়। কিন্তু পুলিশ বলল, এক আঘাতেই হত্যা করা হয়েছে জোবায়েদকে। এটা তো পেশাদার হত্যাকারী ছাড়া কেউ করতে পারার কথা নয়। তাহলে আমাদের প্রশ্ন পেশাদার হত্যাকারী দিয়ে হত্যা করিয়ে অন্যদের ফাঁসানো হয়েছে কি? এ ছাড়া মাহিরের উচ্চতা ও জোবায়েদের উচ্চতায় অনেক তফাত। জোবায়েদ মাহিরের থেকে অনেক লম্বা, সে (মাহির) তার (জোবায়েদ) গলা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারার কথা নয়। সে জায়গা থেকে হত্যা করা সম্ভব কি?’
তিনি আরও বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজে দুজন ব্যক্তিকে দেখা গিয়েছে। একজন কালো টি-শার্ট পরিহিত, আরেকজন লাল টি-শার্ট পরিধান করা ছিল। এই দুজনই কি গ্রেপ্তার হওয়া দুজন কি না, আমরা কীভাবে নিশ্চিত হব? সংশ্লিষ্ট প্রশাসন পর্যাপ্ত প্রমাণ জব্দ করেছে কি না, সেটা আমরা জানতে চাই।’
পুলিশের বিবরণের আরেকটি অংশ নিয়ে প্রশ্ন তুলে এই অধ্যাপক বলেন, ‘অভিযুক্ত বার্জিস শাবনাম বর্ষার মা-বাবার জবানবন্দি নেওয়া প্রয়োজন ছিল, হত্যার সময় বাসায় তাঁরা উপস্থিত ছিলেন। যদি তাঁরা এ ঘটনায় সমর্থন দিয়ে থাকেন, তাঁদেরও তো এই মামলার আসামি হওয়ার কথা। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার কাছ থেকে জবানবন্দি নেওয়ার বিষয়েও পুলিশ স্পষ্ট কিছু জানায়নি।’
এদিকে জোবায়েদ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে বুধবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। সেখান থেকেও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। সমাবেশে পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু সাইদ মো. রিপন রউফ বলেন, ‘গতকাল পুলিশের কর্মকর্তারা যেভাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁরা যেভাবে হাসাহাসি করেছেন, তাতে মনে হয় না, তাঁরা একটি হত্যার বিবরণ দিচ্ছেন। তাঁরা কোনোভাবেই দায়িত্বশীল আচরণ করেননি।’
জোবায়েদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ছাত্রদলের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন।