চট্টগ্রাম নগরীর হাতে গোনা যে কয়েকটি জায়গায় এখনো সবুজের দেখা মেলে তার একটা সিআরবি। ব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি দূর করতে বিকেল হলে সেখানেই ছুটে যায় মানুষ। এ কারণে সিআরবিকে বলা হয় ‘চট্টগ্রাম নগরীর ফুসফুস’। সেই ফুসফুসে এবার চলবে করাত। কেটে ফেলা হবে ৭০টির বেশি গাছ। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে নগরবাসী। গাছ রক্ষায় সোচ্চার পরিবেশবাদীরা।
সিআরবিতে বর্তমান রেলওয়ে হাসপাতালের পাশে খালি জমি এবং আশপাশের জায়গা নিয়ে ছয় একর জমিতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ নির্মাণ করছে রেলওয়ে। ওই জায়গায় রয়েছে প্রায় ৭০টি ছোট গাছ। একটি শতবর্ষী গাছ এবং মাঝারি ধরনের পাহাড় ও টিলা রয়েছে। হাসপাতাল হলে এসব গাছ কাটা পড়বে। তাই জায়গাটিতে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণের বিরোধিতা করছেন পরিবেশবিদ, সাংস্কৃতিককর্মী এমনকি রেলের কর্মচারীরাও।
কাপ্তাই কর্ণুফলী সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ। তাঁর বাসা জামালখান। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিদিন সকালে সিআরবিতে যান শরীরচর্চা করতে। সপ্তাহে অন্তত চার দিন বিকেলে সিআরবির মাটি স্পর্শ করে যান জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা আশরাফুল আলম। তাঁদের মতো অনেকের কাছেই প্রাণ খুলে শ্বাস নেওয়ার জায়গা সিআরবি। শতবর্ষী গাছ, খোলামেলা ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশের কারণে নগরবাসীর বিশেষ আকর্ষণের জায়গায় পরিণত হয়েছে জায়গাটি।
এখানকার গাছ আর পাহাড়-টিলা কেটে হাসপাতাল করতে গিয়ে রেলওয়ে পরিবেশের বড় ক্ষতি করছে বলে মনে করেন খোদ রেলওয়ের প্রকৌশল দপ্তরের সাবেক এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, আমাজন বন যেমন পৃথিবীর ফুসফুস, তেমনি সিআরবিও চট্টগ্রাম মহানগরীর ফুসফুস। কারণ সিআরবি ও পাহাড়তলীর গাছগুলো নগরের অক্সিজেনের অন্যতম উৎস। গাছ কেটে বিনাশ করা হলে নগরের তাপমাত্রা বর্তমানের চেয়ে আরও ২ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। সেই সঙ্গে নগরের বাতাসে কার্বন ডাই–অক্সাইডের পরিমাণ ১০ শতাংশ বেড়ে যাবে।
পরিবেশবিদ ও কর্ণফুলীর গবেষক ড. ইদ্রিস আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শহরের প্রাণকেন্দ্রের ভেতরে হাসপাতাল হতে হবে, এমনটা বাধ্যতামূলক নয়। সিআরবির মুক্ত পরিবেশ নগরীর মানুষের স্বস্তির জায়গা। হাসপাতাল হলে সেটির মারাত্মক বিপর্যয় ঘটাবে। এখানকার ইকো সিস্টেম-কীট-পতঙ্গ, পাখির হাঁটাচলা বাধাগ্রস্ত করবে। পরিবেশ রক্ষায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যতই পদক্ষেপ নিক, হাসপাতালের জৈব পদার্থ এই অঞ্চলকে হুমকির মুখে ফেলবে।’
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) এই প্রকল্পে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে ইউনাইটেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ কোম্পানি লিমিটেড। প্রকল্পের ছয় একর জমির মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ২ দশমিক ৪২ একর এবং দ্বিতীয় ধাপে ৩ দশমিক ৫৮ একর জমি ব্যবহার করবে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, নির্মাণকালে প্রথম পর্যায়ের তিন বছরে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ কমপক্ষে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে দুই বছরে আরও ২৫০ শয্যার হাসপাতাল কার্যক্রম চালু করবে। পরবর্তী ১২ বছরের মধ্যে বেসরকারি অংশীদার ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম শুরু করবে।
প্রকল্প পরিচালক ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) মো. আহসান জাবির বলেন, ‘কেউ বলছে, শিরীষতলায় হাসপাতাল হচ্ছে, আর কেউ বলছে, সব গাছ-পাহাড় কেটে রেলওয়ে হাসপাতাল করছে। এসব তো মিথ্যা। হাসপাতাল নির্মাণে সরকার অনুমোদন দিয়েছে। আমরা সেটির বাস্তবায়ন করছি। একটি শতবর্ষী গাছ রয়েছে, আর পাহাড়-টিলা অক্ষত রেখে হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে।’ এত দিন পর কিছু মানুষের প্রতিবাদকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক কায়েস খলিল খান (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এই হাসপাতাল থেকে বিশ্বমানের সেবা পাবেন নগরবাসী। রেলকর্মীরাও ২০ শতাংশ কম অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসাসেবা নিতে পারবেন। এটি সরকারের প্রকল্প। আমরা তো জাস্ট নির্মাণ করে দিচ্ছি।’
রেলওয়ের সিআরবিতেই হাসপাতাল হবে : নগরবাসী ও পরিবেশবাদীদের বিরোধিতার পরেও সিআরবিতে হাসপাতাল হবে কি না, জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সিআরবিতে হাসপাতাল না করলে কি চট্টগ্রামের পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যাবে। পরিবেশবাদীরা যদি এত তৎপর হয়, তাহলে চট্টগ্রামে এত পানি ওঠে কীভাবে…পাহাড় কাটে কেমনে? হাসপাতাল হলে পরিবেশবাদী... তাহলে পাহাড় কাটে কেমনে? এটি প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত। যারা বিরোধিতা করছে, তাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।’