মাস দু-এক আগে বাড়ি থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়ে ঘর থেকে বেরোতেই এক দাদুর সঙ্গে দেখা। আমাকে দেখেই দাদু বলল, ‘ভাই, সাবধানে গাড়ি ঘোড়ায় চলাচল করিস। মড়ক তো এহন সড়কেই। পইত্তেক দিন কত মানুষ একসিডেন করতাসে আর মরতাসে।’
‘আচ্ছা দাদু’ বলে আমি তখন বের হয়ে গেলাম। বাড়ির সীমানা পর্যন্ত আমার মা দাদুর কথাগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছিল। কিন্তু মাকে বিদায় দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও, আমার মাথায় দাদুর সড়কে মড়কের কথাটা ঘোরপাক খাচ্ছিল।
‘মড়ক’ শব্দটি সাধারণত মহামারি অর্থে ব্যবহৃত হয়। ছোঁয়াচে রোগ না বলে, সড়ক দুর্ঘটনা বা সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে মহামারি বলা যায় না। কিন্তু ছোঁয়াচে রোগের শর্তকে পাশে রেখে, সড়ক দুর্ঘটনা ও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুগুলোকে, কী শুধু সংখ্যার ভিত্তিতে ‘মড়ক’ বা মহামারি বলা যাবে? কারণ আমাদের দেশে প্রতিদিনই অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে এবং মৃত্যু হচ্ছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সংগৃহীত গত কয়েক বছরের সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যার দিকে তাকানো যাক।
২০২১ সালের আগস্ট ও ডিসেম্বর মাস ছাড়া বাকি ১০ মাসে ৩ হাজার ৬৫২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৩৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২১ সালেও কয়েক দফায় ৬০ দিনের বেশি যান চলাচল বন্ধ ছিল। সহজেই বোঝা যাচ্ছে, বাকি দুই মাসের তথ্য যোগ করলে তা ২০২০-কে ছুঁয়ে ফেলবে বা ছাড়িয়ে যাবে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মোটরসাইকেল যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে সবচেয়ে বেশি। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২০১৯ সালে ৯৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সংখ্যা ২০২০ সালে বেড়েছে এবং ২০২১ সালের ১০ মাসের হিসাব বলছে, আগের হিসাব ছাড়িয়ে যাবে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত (ডিসেম্বর ও আগস্ট বাদে) ৩৪ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৬ হাজার ৯২৪ জন মারা গেছেন। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন সড়কে প্রাণ গেছে ১৬ জনের।
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের কোভিড ড্যাশবোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে করোনায় আমাদের দেশে মারা গেছে (১ জানুয়ারি পর্যন্ত) ২৮ হাজার ৮৭ জন। গড়ে প্রতিদিন ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ভয়াবহ ছোঁয়াচে রোগ করোনাভাইরাসে যেখানে প্রতিদিন গড়ে ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে সেখানে আমাদের দেশের সড়কে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ১৬ জন। এটাকে কি মড়ক বলা যায় না?
এখন কথা হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনাকে ‘মড়ক’ বলি আর নিছক দুর্ঘটনা বলি, প্রতিদিন কিন্তু গড়ে ১৬ জনের মৃত্যু হচ্ছে। এই মৃত্যুর মিছিল থামানোর কি কোনো উপায় নেই?
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, আন্দোলনের পরও তো আমাদের সড়কে দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনায় মৃত্যু কমেনি। উল্টো বছর বছর বেড়েছে। তাহলে শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো কি কথার কথা ছিল? বেশির ভাগ আন্দোলন যেভাবে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি দিয়ে থামানো হয়, ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের নিয়তিও কি সেই বেশির ভাগ আন্দোলনের মতোই? তাহলে কি ধরেই নেওয়া যায়, ২০২০-এর আন্দোলনও সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে এবং আমাদের সড়কে মৃত্যুর মিছিল আরও দীর্ঘ হবে?
করোনা মড়ক থামানোর জন্য সারা পৃথিবীতে অনেক চেষ্টাচরিত হচ্ছে। নভেল করোনাভাইরাসকে সমূলে উৎপাটন করা না গেলেও সংক্রমণ বিস্তার রোধে অনেক উন্নতি ও আশা দেখা গেছে। কিন্তু আমাদের সড়কের এই ‘মড়ক’ ঠেকাবে কে?