ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর ট্যাংকগুলো একটি দুর্দশাপূর্ণ সময় পার করছে। যুদ্ধক্ষেত্রে দেশটি প্রায় ১৫৩টি ট্যাংক ও ৩১২টি সাঁজোয়া যান হারিয়েছে। ওপেন-সোর্স ইন্টেলিজেন্স ব্লগ ওরিক্সের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট এ সংখ্যা জানিয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তাদের যথাক্রমে ২৬টি ট্যাংক ও ৫৭টি সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়েছে। যদিও এই দাবি একান্তই কিয়েভের। কিন্তু ট্যাংকের এমন দুর্দিন কেন এবং কীভাবে টিকে থাকতে পারে আগামী দিনে—এমন প্রশ্নও উঠছে এখন। তাই সমর বিশারদেরা বলছেন, ট্যাংক প্রতিরক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণের পর ৩৭ দিনের যুদ্ধে রাশিয়ার সাঁজোয়া যান ও ট্যাংক হারানোর সংখ্যাটি একেবারেই কম নয়। অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন দেশের সমর বিশারদেরা আগামীর যুদ্ধে ট্যাংকের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাচ্ছে বলেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন। বছরখানেক আগে, ব্রিটিশ সেনাপ্রধান জেনারেল মার্ক কার্লটন স্মিথ বলেছিলেন, তিনি মনে করেন—আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংকের অপ্রতিরোধ্য রূপ অনেকটাই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। তাই এর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তাঁরই কথার প্রতিধ্বনি করছে ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’।
ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু যুক্তরাজ্য নয়, পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রও একই পথে হাঁটছে। দেশটি বিশাল ট্যাংকবহর সমরসজ্জা থেকে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। কারণ, প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের মোকাবিলায় ট্যাংকের প্রয়োজনীয়তা খুব কম। সিরিয়া যুদ্ধেও তুর্কি ড্রোনের হাতে মার খেয়েছে ট্যাংকবহর। ফলে ট্যাংকের যে আগের দিন নেই তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে বিশ্বের অন্যতম পুরোনো থিংক ট্যাংক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ নিক রেনল্ডস ও জ্যাক ওয়াটলিং মনে করেন, যুদ্ধের ময়দানে ট্যাংকের মতো ভারী বর্মের সাঁজোয়া যান ব্যবহারের যে ধারণা এখনো আছে, তার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ জাগাটা অযৌক্তিক নয়। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান হারানোর সংখ্যা রেনল্ডস ও ওয়াটলিংয়ের মতকেই প্রতিষ্ঠিত করছে। ট্যাংকের কার্যকারিতা প্রকৃতপক্ষেই হুমকির মুখে পড়েছে।
ইউক্রেন সেনাবাহিনী রাশিয়ার যেসব ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ধ্বংস করেছে তার বেশির ভাগই পদাতিক সেনাদের কাঁধে বহনযোগ্য অ্যান্টি-ট্যাংক গাইডেড মিসাইল (এটিজিএম) দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনে কয়েক হাজার এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে—আমেরিকার জ্যাভলিন, সুইডিশ এনলস, জার্মান প্যানজারফাউস্ত-৩ এস। ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা জেন্সের ‘ল্যান্ড ওয়ারফেয়ার’ কৌশলের গুরু বলে খ্যাত জন হকস বলছেন, ‘এই যুদ্ধ (ইউক্রেন যুদ্ধ) আধুনিক আর্মার্ড ভেহিকেলের জন্য যে হুমকি স্পষ্ট হয়েছে তার একটি উল্লেখযোগ্য প্রদর্শনী।’
এপিএস প্রধানত দুই প্রকার: ‘সফট-কিল’ ও ‘হার্ড-কিল’। সফট কিল এপিএস তার দিকে আগত ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ ইনফ্রারেড বা লেজার রশ্মি দিয়ে ভিন্ন দিকে পরিচালিত করা যায়। বিপরীতে হার্ড কিল সিস্টেম হলো আগত ক্ষেপণাস্ত্রকে পাল্টা আঘাত হেনে ধ্বংস করা।
তবে ইউক্রেনে সফট কিল সিস্টেম পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা গেছে। রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন, ‘আপনি যে সিস্টেমটি ব্যর্থ করতে চেষ্টা করছেন সে বিষয়ে একটি উপযুক্ত প্রযুক্তিগত বোঝাপড়ার প্রয়োজন।’ কারণ, ইউক্রেনের সৈন্যরা যে পদ্ধতিতে তাদের অ্যান্টি ট্যাংক গাইডেড মিসাইল সিস্টেম ব্যবহার করেছে তা রাশিয়ার আর্মার্ড ভেহিকেলগুলোর পক্ষে জ্যাম করা সম্ভব নয়।
তবে হার্ড-কিল সিস্টেমেরও সমস্যা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আগত ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করতে হলে প্রয়োজন অত্যাধুনিক রাডার এবং আগত ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করে সেগুলোতে আঘাত করার জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্য। এ ছাড়া, ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর যে গতি তা হিসাবে আনাও জরুরি।
কিন্তু এরপরও কেন ইউক্রেনে রাশিয়ার ট্যাংক এবং আর্মার্ড ভেহিকেলগুলো দুর্দশায় পতিত তা বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন।
হার্ড কিল এপিএস সিস্টেমে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর একটি হলো ইসরায়েল। রাফায়েলের (যুদ্ধবিমান) জন্য নকশা করা এই সিস্টেম দেশটির মেরকাভা ট্যাংকগুলোতে লাগানো হয়েছে। এই সিস্টেমের বৈশিষ্ট্য হলো—এটি সুনির্দিষ্টভাবে আগত লক্ষ্যবস্তুর দিকে ‘স্প্রেড ফায়ার’ করে এবং নিকটস্থ পদাতিক বাহিনীর সম্ভাব্য বিপদ কমিয়ে আনে। ইসরায়েলের দাবি, তাদের এই সিস্টেম গাজায় অনেক ট্যাংক-বিধ্বংসী রকেট আক্রমণকে প্রতিহত করেছে। তবে জন হকস বলছেন, এ ধরনের আক্রমণ (গাজা থেকে আগত রকেট হামলা) সম্ভবত পুরোনো দুর্বল অ্যান্টি ট্যাংক গাইডেড মিসাইল থেকে আসা, ফলে ক্ষয়ক্ষতিও কম।
এই ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নেতিবাচক দিকও রয়েছে। অ্যাকটিভ প্রোটেকশন সিস্টেমের ওজন, এটি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা এবং শক্তি প্রয়োজন হয় তা সরবরাহ করতে গিয়ে ট্যাংকের প্রয়োজনীয় অস্ত্রগুলো কমিয়ে ফেলার ঝুঁকিতে পড়বে। জ্যাক ওয়াটলিংয়ের মতে, পশ্চিমা ট্যাংকগুলো কার্যক্ষমতার সঙ্গে আপস না করায় ওজনে বেশ ভারী হয়ে যায়। ফলে এতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য খুব অল্প জায়গায়ই অবশিষ্ট থাকে।
হার্ড কিল সিস্টেম কেবল হাতে গোনা আগত কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে পারে—যেহেতু এতে পর্যাপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র বিরোধী গোলা মজুত করা যায় না। আর করলে পদাতিক বাহিনীকে সহায়তা দিতে যে পরিমাণ অস্ত্র–গোলাবারুদ প্রয়োজন তা ধারণ করতে পারে না। এ ছাড়া, একটি সফল প্রতিরোধ শেষে যে ধ্বংসাবশেষ ছুটে আসে তা দিয়ে ট্যাংকের রাডারেরও ক্ষতি হতে পারে। জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, প্রতিপক্ষ যদি একটু চালাক হয় তবে, রাডার নিষ্ক্রিয় করার জন্য দূর থেকে মেশিনগানের গুলি দিয়েও ট্যাংকগুলোকে টার্গেট করতে পারে। যার ফলে, ট্যাংকে থাকা অ্যান্টি অ্যাকটিভ প্রোটেকশন সিস্টেমের কার্যকারিতা হ্রাস পায় অনেকাংশে।
তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার ট্যাংকের অবস্থা নির্দেশ করছে—‘ওনিয়ন স্টাইল’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে আরও একটি স্তর যুক্ত করতে পারলে তা সত্যিই আরও কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে।
বিশ্লেষণ সম্পর্কিত পড়ুন: