হোম > বিশ্লেষণ

তালেবান নিয়ে কার কী অবস্থান

ফজলুল কবির

আফগানিস্তানের ভাগ্য এখন আর অস্পষ্ট নয়। তালেবানের হাতেই ক্ষমতা যাচ্ছে দেশটির। এটা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। কাবুলে তালেবান প্রবেশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশ ছেড়েছেন। তালেবান পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে তারা আফগান সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছে। অবশ্য এই শান্তি আলোচনা বেশ আগে থেকেই চলছিল কাতারের দোহায়। কিন্তু তখন ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে দুই পক্ষে কোনো সমঝোতা হয়নি। এখন যখন গোটা আফগানিস্তান তালেবান নিয়ন্ত্রণে, তখন এ আলোচনার অভিমুখ নিয়ে আর প্রশ্ন থাকার কথা নয়। 

আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি এরই মধ্যে পাড়ি জমিয়েছেন তাজিকিস্তানে। সেখানেই তিনি অবস্থান করবেন, নাকি অন্য কোথাও পাড়ি জমাবেন, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সরে যাওয়া যে তাঁকে শুধু নয়, বহু আফগানকে এক ভীষণ অনিশ্চয়তার মধ্যে এনে ফেলেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।  

আজ রোববার যখন কাবুলে প্রবেশ করে তালেবানরা, তখনই এই দুই দশকের যুদ্ধ ও মৃত্যুর আখ্যানের একটি পর্দা পড়তে শুরু করে। তবে এটা বলবার সুযোগ নেই যে, এই পর্দা আর উঠবে না। এটুকু শুধু এই মুহূর্তে বলা যায়, পর্দা উঠলেও তাতে সময় লাগবে। মঞ্চে নতুন দ্বৈরথ হয়তো হাজির হতে পারে। 

কিন্তু এখনই প্রশ্ন উঠে গেছে যে, এই দুই দশকের যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র যে এত এত ডলার বিনিয়োগ করল, দুই পক্ষের যে এত প্রাণহানি হলো, তার ফল কী? কাবুলে তালেবান প্রবেশের কিছুক্ষণের মধ্যেই মার্কিন কূটনীতিকেরা হেলিকপ্টারে চড়ে সটকে পড়েন। তাঁদের সরিয়ে নিতে গতকাল শনিবারই নতুন করে বাহিনী পাঠিয়েছিল জো বাইডেন প্রশাসন। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নতুন করে আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েনের মতো পদক্ষেপ নিচ্ছেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু আজ কূটনীতিকদের সরিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে সেই গুঞ্জনের সমাপ্তি হলো। যুক্তরাষ্ট্র আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব সেনা সরিয়ে নেওয়ার পূর্ব সিদ্ধান্তেই অটল রয়েছে বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউস। 

প্রশ্ন হলো তাহলে, এই এত এত বিনিয়োগের কী হবে? ব্রাউন ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, আফগান যুদ্ধে দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। সঙ্গে সম্মিলিত বাহিনীর সেনাক্ষয় যোগ করলে এর ব্যাপকতা আরও বোঝা যাবে। এই দুই হিসাবই এখন মেলাতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। 

এরই মধ্যে এই হিসাবকে সামনে রেখে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন আফগান যুদ্ধে যোগ দেওয়া মার্কিন সেনারা। একই প্রশ্ন তুলছেন মার্কিন উপস্থিতিকে সমর্থন জানানো আফগান নাগরিকেরাও। ঘরবাড়ি ছেড়ে পালানোর সময় তাদের চোখে অবিশ্বাস আর গোপন থাকেনি। 

ক্ষমতায় তালেবান উপস্থিতি মানতে না পারা আফগানের সংখ্যা তো কম নয়। তাদের তাই আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে হচ্ছে। আর এই পালানোর স্রোত এরই মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে দেশটির সীমান্তবর্তী দেশগুলোয়। এ তালিকায় রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইরানসহ মধ্য এশীয় দেশগুলো। এই উদ্বেগ স্বাভাবিকভাবেই এই দেশগুলোর প্রতিরক্ষা বাজেটকে বাড়িয়ে তলবে। মাঝে থেকে লাভের মিঠাই ঢুকবে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের হাতে। 

বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, আফগানিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হিসাব হয় বরাবরই ভুলে ভরা ছিল, নয় তো তারা সত্য লুকিয়েছে। গত জুনে মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের প্রতিবেদনে আফগান সরকার ছয় মাসের মধ্যে তালেবানের হাতে ধরাশায়ী হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু আজ দেখা গেল, এটি এমনকি শেষ মার্কিন সেনা চলে যাওয়ার জন্যও অপেক্ষা করেনি। অর্থাৎ, এত দিন আফগানিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানীগুলোতেই শুধু মার্কিন সমর্থনপুষ্ট আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল। বাকি যে নিয়ন্ত্রণ ও স্বাভাবিকীকরণের গল্প, তা চাপা পড়েছে দুর্নীতি ও অতিকথনের নিচে। 

আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালেবান বসা নিয়ে বারবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গ ফিরে আসছে। কারণ, এই যুদ্ধে ওয়াশিংটন ভীষণ একগুঁয়েভাবে নিয়েছিল। ফলে এটি তার প্রেস্টিজ ম্যাটার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এত বিনিয়োগের পরও কোনো ফল না মেলায় লাখো আফগানকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে এখন তারা সব গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি বুলি পকেটে পুরে চলে যাচ্ছে। একবারও দেশটির ভাগ্য নিয়ে তারা ভাবছে না। কিন্তু এই একই পরিস্থিতি আফগানিস্তানের প্রতিবেশী সব দেশকে ভাবিয়ে তুলেছে। তারা সবাই একযোগে এক নতুন শরণার্থী স্রোত দেখতে পাচ্ছে, যা শুরু হয়েছিল প্রথম দফায় ১৯৯৬ সালে। তখন সংখ্যাটি কম থাকলেও ২০০১ সালের পর তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এখন ঠিক একই শঙ্কা দেখা যাচ্ছে আবার। 

ফলে রাশিয়ার পক্ষ থেকে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। চীনও এমনকি নিজের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে নতুন অঙ্ক কষবে কিনা, ভাবছে। তাদের মূল শঙ্কা আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে। যে ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য বিআরআই প্রকল্প, আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতায় তো তা–ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবার আগে। আর ভারতের উদ্বেগের কারণটি রয়েছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কের কারণে। মূলত কাশ্মীর, লাদাখ অঞ্চল নিয়ে তাকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। আর শিয়া বিরোধী অবস্থানের কারণে তালেবানের বিপক্ষে আগে থেকেই আছে ইরান। ফলে ইরানের সমর্থন তালেবান পাচ্ছে না—এটা এক রকম নিশ্চিত। 

রাশিয়া এরই মধ্যে সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে। তাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলতি বছরের শেষ দিকে তারা আফগানিস্তান সংলগ্ন এলাকায় থাকা ঘাঁটিগুলোর শক্তি বাড়াতে কাজ করবে। এই ঘোষণাটি যখন ছিল, তখনো তালেবান নিয়ন্ত্রণ সম্প্রসারিত হয়নি। ফলে নতুন পরিস্থিতিতে ক্রেমলিন কী করে, তা দেখার বিষয়। বিষয়টি নিয়ে যে তারা গুরুতরভাবে ভাবছে, তা স্পষ্ট হয়েছে বাইডেন–পুতিন প্রথম বৈঠকে। পুতিন সেখানে বাইডেনকে সরাসরি প্রস্তাব দিয়েছেন, তালেবানের সঙ্গে কোনো দ্বৈরথে জড়ালে যুক্তরাষ্ট্র রুশ ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে। বাইডেন এ বিষয়ে অবশ্য তেমন কিছু বলেননি। তবে এটা স্পষ্ট যে, পুতিন যেকোনোভাবে নিজের সীমান্ত এবং তাজাখস্তান, কিরগিজস্তানসহ রুশ বলয়ে থাকা দেশগুলোকে তালেবান প্রভাবমুক্ত রাখতে চান। একই সঙ্গে এসব অঞ্চলে কোনো মার্কিন ঘাঁটি দেখতে চান না। কারণ রাশিয়া এরই মধ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র আফগান পরিস্থিতির মীমাংসার বদলে এখন বরং চীন, রাশিয়া ও ইরানের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চায়। তাই মধ্য এশিয়া অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র যেকোনোভাবেই হোক নিজেদের একটি ঘাঁটি চায়। আফগান পরিস্থিতিকে পুঁজি করে যুক্তরাষ্ট্র এখন রাশিয়ার দেওয়া সতর্কবার্তা অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ নিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ ক্ষেত্রে তার পছন্দের তালিকায় থাকতে পারে কিরগিজস্তান, তাজাখস্তান বা উজবেকিস্তানের মতো দেশগুলো। 

তবে একই রকম কোনো সুযোগ যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটো বাহিনী চীন ও ইরানের কাছ থেকে পাবে না—এটা নিশ্চিত। এই দুই দেশই নিজেদের মতো করে এগোবে। চীন নিজের বাণিজ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যদি তালেবানকে পাশে পায়, এবং তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার কোনো ক্ষতি না করে, তবে মসনদ নিয়ে তার কোনো ভাবনা নেই। তার ঝুলিতে না আছে গণতন্ত্র, না আছে এমন কোনো শ্রুতিমধুর শব্দভান্ডার, যা যুক্তরাষ্ট্র দুই দশকেও আফগানিস্তানে রপ্তানি করতে পারেনি। 

তবে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে পাকিস্তানের রাজনীতিতে। দেশটিতে থাকা কট্টর ইসলামি গোষ্ঠীগুলো আবার শক্তি পেতে শুরু করেছে। অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বৃদ্ধির আশঙ্কাও প্রবল। ফলে এমন যেকোনো পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পুরোনো মিত্র হিসেবে দেশটির সেনাবাহিনী নিজেদের ঘাঁটি ব্যবহারের পথটি খুলে দেবে বলেই মনে হয়। 

প্রভাব পড়বে কোনো সীমান্ত ভাগ না করা বাংলাদেশের ওপরও। দেশের ইসলামি দলগুলো নতুন করে কণ্ঠে জোর পাবে। আর এই জোর শেষ পর্যন্ত কী পরিমাণ অস্থিরতার জন্ম দেয়, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে একটা নতুন সংকটের মধ্য দিয়ে যে দেশ যাবে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সব মিলিয়ে গোটা অঞ্চলই এক নতুন পরিস্থিতির মধ্য ঢুকছে। এই ২০ বছরে তালেবান রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ব হয়েছে, স্বীকার করতে হবে। কিন্তু নারী, শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে অবস্থানের বদল হয়েছে, তা বলবার তেমন সুযোগ নেই। কাবুল প্রবেশের পর যেভাবে দেয়াল থেকে নারীদের ছবি মুছে দেওয়া হলো, তা কিন্তু পুরোনো কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। যদিও মুখে তারা নারী অধিকারকে সম্মান জানানোর কথা বলছে। কিন্তু ২০ বছর আগের তালেবান শাসনের কথাই বারবার ফিরে আসছে এখন মানুষের মনে। তালেবান শাসনের অধীনে আফগানিস্তান আবার শরিয়া আইনে ফিরে গেলে এর প্রভাব গোটা অঞ্চলে তো বটেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকেও ছাড়বে বলে মনে হয় না।

নাইজেরিয়ায় কোন আইএসকে আঘাত করল মার্কিন বাহিনী

নাইজেরিয়ায় কেন হামলা চালাল মার্কিন বাহিনী, খ্রিষ্টান নিপীড়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

ইরান ও ইসরায়েলে সমানতালে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি

পাকিস্তানকে এফ-১৬ আধুনিকীকরণের প্যাকেজ, ভারতকে কী বার্তা দিতে চান ট্রাম্প

ডার্ক ফ্লিট: নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেভাবে চলে ইরান ও ভেনেজুয়েলার তেল পাচার

এআই চাকরি কেড়ে নিচ্ছে আমেরিকায়, কিন্তু নিয়োগ বাড়াচ্ছে ভারতে—কীভাবে