হোম > রাজনীতি

বহু মানুষের স্বপ্ন নষ্ট করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন—বিস্ফোরক অভিযোগ কেন তুললেন উমামা ফাতেমা

গত বছর কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় ৪ জুলাই শাহবাগ মোড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমাবেশে মেয়েদের জমায়েতে উমামা ফাতেমা। ছবি: ফেসবুক

দীর্ঘ এক ফেসবুক পোস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে নিজের আনুষ্ঠানিক বিদায়ের ঘোষণা দিলেন সংগঠনটির সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। বিদায়ের ঘোষণার চেয়ে এটি হয়ে উঠেছে এক বিস্ফোরক দলিল, যেখানে উঠে এসেছে সংগঠনের অভ্যন্তরীণ সংকট, আদর্শচ্যুতি, সুবিধাবাদ ও রাজনৈতিক কৌশলের জটিল সমন্বয়। আর এসব অভিযোগের সারমর্মে উমামার দাবি, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বহু মানুষের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে’।

কেন এমন মারাত্মক ও বিস্ফোরক অভিযোগ তুললেন জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদাতা সংগঠনটির সামনের সারির গুরুত্বপূর্ণ এই নেত্রী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে উঠে আসে কীভাবে একটি ‘আদর্শবাদী প্ল্যাটফর্ম’ প্রায় ১১ মাসের ব্যবধানে অবিশ্বাস, বিভক্তি ও আদর্শের বিপরীতমুখী আচরণের শিকার হয়ে পড়েছে।

কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা যে আন্দোলন নজিরবিহীনভাবে সরকারপতনের আন্দোলনের রূপ নিয়েছিল, সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ‘অভ্যুত্থান’ হলো। সেই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল বৈষম্য ও নিপীড়নহীন নতুন এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। কর্তৃত্ববাদ, দখল, দুর্নীতি ও মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতি ছিল সেই অভ্যুত্থানের নেতাদের। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের জেদ এবং স্বপ্নকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল এই প্ল্যাটফর্ম।

দেশের রাজনীতিতে ভিন্নধর্মী ধারার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এই প্ল্যাটফর্ম আত্মপ্রকাশ করেছিল। দারিদ্র্য, বৈষম্য, শাসনব্যবস্থার অকার্যকারিতা ও রাজনৈতিক পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ‘জনতার পক্ষের রাজনীতি’ করার অঙ্গীকার ছিল তাদের। তরুণদের প্রত্যাশা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহরে সংঘবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে সংগঠনটি স্বল্প সময়ের মধ্যে জনমনে জায়গা করে নেয়।

তখন অনেকে মনে করেছিলেন, এটি বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির এক বিকল্প ভবিষ্যৎ। তবে এই আশাবাদের বাতাস খুব দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে। এক বছর পূর্তির আগেই সংগঠনটি এখন তীব্র বিতর্ক, নেতৃত্ব সংকট, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও আদর্শচ্যুতির অভিযোগে জর্জরিত। একসময়ের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা সংগঠন থেকে নিজের বিদায় ঘোষণা করে ফেসবুকে যেসব বিস্ফোরক অভিযোগ তুলেছেন, তা সংগঠনের আদর্শিক পাটাতনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

১. নেতৃত্বে অনিয়ম ও দলীয় হস্তক্ষেপ

উমামা ফাতেমার বক্তব্য অনুযায়ী, সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচন ছিল একপক্ষীয় ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। ২০২৫ সালের জুনে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে অংশ নেওয়া অধিকাংশ ভোটার নাকি একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট। অনেক যোগ্য কর্মী প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পাননি। এমনকি যাঁরা ভোটে অংশ নেননি, তাঁরাও পরে কাউন্সিলের সদস্য হয়ে যান। এ ঘটনাকে উমামা আখ্যা দেন ‘ভাই-ব্রাদার কোরামের খেলা’।

২. মুখপাত্র হলেও মিডিয়া বা পেজ নিয়ন্ত্রণ ছিল না

একজন মুখপাত্র হিসেবে সংগঠনের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যবহারের অধিকার থাকা উচিত। অথচ উমামা অভিযোগ করেছেন, তাঁকে এক্সেস দেওয়া হয়নি; বরং সেই পেজ থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে পোস্ট করা হয়। অর্থাৎ, একদিকে তাঁকে সংগঠনের মুখ বলা হলেও অন্যদিকে তাঁকেই জনসমক্ষে বিব্রত করা হয়েছে—যা নেতৃত্বের দ্বিচারিতা ও প্রতিহিংসার ইঙ্গিত দেয়।

৩. অভ্যন্তরীণ ভাঙন ও কলঙ্কলেপন

উমামা দাবি করেন, একসময়ের সহযোদ্ধারাই জুনিয়রদের ব্যবহার করে তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালান। তিনি লেখেন, ‘যে মানুষগুলোর সঙ্গে আমি মিছিল করেছি, তারাই পরিকল্পিতভাবে আমার বিরুদ্ধে Smear campaign চালিয়েছে।’ এ থেকে বোঝা যায়, প্ল্যাটফর্মে সহমতের রাজনীতি নয়, বরং ব্যক্তিকেন্দ্রিক বলয়ের আধিপত্য ছিল।

৪. আদর্শচ্যুতি ও সুবিধাবাদ

উমামা ফাতেমার ভাষায়, ‘এই প্ল্যাটফর্ম এখন টিস্যু পেপারের মতো মানুষকে ব্যবহার করে।’ তিনি অভিযোগ করেন, ক্ষমতার নিকটবর্তী হতেই অনেক নেতা রাজনৈতিক সুবিধা নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। একসময় যারা ‘জুলাই অভ্যুত্থান’, ‘সংস্কার’, ‘শহীদ’ কিংবা ‘আহতদের’ নিয়ে কথা বলতেন, তাঁরাই পরে দলীয় হাই কমান্ডের প্রতি আনুগত্য দেখাতে থাকেন।

৫. দলীয় লেজুড়বৃত্তি না মানায় চাপ

উমামা লেখেন, ‘আমি যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতাম, অনেকের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়ত। তাই অনলাইন, অফলাইনে ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করা হয়।’ তার মানে, প্ল্যাটফর্মটিকে আদর্শিক নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য রাখতে চেয়েছে একাধিক শক্তি।

৬. ‘বদ্ধ জলাশয়’ ও ‘পোকার মতো’ তুলনার তাৎপর্য

মার্চ-এপ্রিল মাসে প্ল্যাটফর্মের অভ্যন্তরীণ অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে উমামা বলেছেন, এটি ‘বদ্ধ জলাশয়’—যেখানে পচন ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, এটি এমন একটি পরিবেশ, যেখানে ‘পোকার মতো সুবিধাবাদীরা’ সবকিছু খেয়ে ফেলছে।

এটি শুধুই রাজনৈতিক বাগ্মিতা; বরং হতাশাজনক বাস্তবতার খোলামেলা স্বীকারোক্তি। তাঁর মতে, গুডউইল বা সদিচ্ছা থাকা মানুষগুলো সৎভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি, তাঁরা সুবিধাবাদীদের কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।

৭. ভাঙনের ইঙ্গিত: আত্মবিশ্বাসহীন ভবিষ্যৎ

উমামা ফাতেমা কেবল সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেননি, তিনি সেই কাউন্সিলের ভোটও প্রত্যাহার করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর তাঁর কোনো আস্থা নেই।

তিনি বলেছেন, ‘যারা অভ্যুত্থানকে বাজারদরে কেনাবেচা করেছে, আমি তাদের কখনো ক্ষমা করব না।’ তাঁর কণ্ঠে ব্যক্তিগত ক্ষোভ থাকলেও তা বৃহত্তর প্রজন্মের হতাশার প্রতিধ্বনি হয়ে উঠেছে।

ভেঙে পড়া স্বপ্নের দায় কার

উমামা ফাতেমার মতো নেত্রী যখন বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘বহু মানুষের স্বপ্ন নষ্ট করেছে’, তখন সেটিকে কেবল ক্ষোভ নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যর্থতার দলিল হিসেবেই দেখতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কি আদর্শিকভাবে ভেঙে পড়ল? নাকি এটি এখনো আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজেদের গন্তব্য পুনরুদ্ধার করতে পারে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সময় দেবে। তবে উমামার বক্তব্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—প্রতিটি আদর্শিক আন্দোলনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হয় ক্ষমতা পাওয়া পর। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই পরীক্ষায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন উত্তীর্ণ হওয়ার মতো কোনো নিদর্শন এখনো দেখাতে পারেনি। বরং, তাদের এক বছরের কর্মকাণ্ডে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী হয়ে আছে।

মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জানাজার প্রস্তুতি নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী

হাসপাতালে খালেদার শেষ দিনগুলো

দেড় দশকের ছায়াসঙ্গী ফাতেমা

ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধাদের স্মৃতিতে খালেদা জিয়া যেমন

মনোনয়নপত্র দাখিলে শীর্ষে বিএনপি, এরপর জামায়াত

হাদির মায়ের চিকিৎসার খোঁজ নিতে হাসপাতালে জামায়াত আমির

খালেদা জিয়াকে শ্রদ্ধা জানাতে আসছেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা

খালেদা জিয়ার মৃত্যুর দায় শেখ হাসিনা এড়াতে পারে না: রাশেদ খান

রুমিন ফারহানাসহ আরও যাঁদের বহিষ্কার করল বিএনপি

বিএনপির সব পদ থেকে রুমিন ফারহানাকে বহিষ্কার