হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

নিম্ন প্রবৃদ্ধি রোধে প্রয়োজন নীতিকাঠামোর পরিবর্তন

আবু তাহের খান 

মোট দেশজ উপাদান (জিডিপি), প্রবৃদ্ধির হার ও মাথাপিছু আয়সংক্রান্ত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের তথ্য থেকে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী উল্লিখিত সবকটি সূচকের ক্ষেত্রেই পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় বড় মাত্রার পতন ঘটেছে। আর এমনটি ঘটার পেছনকার অন্যতম কারণ হচ্ছে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হারের বড় মাত্রার পতন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ৮.৩৭ শতাংশ, সেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা ৩.৫১ শতাংশে নেমে এসেছে। এবং আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে উৎপাদনশিল্পের ব্যাপারে রাষ্ট্রের বিরাজমান নীতিকাঠামো ও দৃষ্টিভঙ্গি অব্যাহত থাকলে নিকট ভবিষ্যতের দিনগুলোতেও এ খাতে প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখী প্রবণতা একই ধারায় বা তার চেয়েও খারাপভাবে অব্যাহত থাকতে পারে, যার নেতিবাচক প্রভাব সামগ্রিকভাবে দেশের জিডিপি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক সূচকের ওপর পড়তে বাধ্য। এ অবস্থায় শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হারের উল্লিখিত নিম্নমুখী ধারা রুখতে হলে অবশ্যই সর্বাগ্রে উৎপাদনশিল্পের ব্যাপারে রাষ্ট্রের নীতিকাঠামো ও দৃষ্টিভঙ্গিকে আমূল ঢেলে সাজাতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেটি কীভাবে করা যাবে?

এ ক্ষেত্রে একেবারে প্রথমেই স্মরণ করা প্রয়োজন যে দেশে বর্তমানে যেহেতু একটি স্বল্পকালীন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে বা ক্ষমতায় আছে, সেহেতু এ স্বল্পকালীন সরকারের পক্ষে এ বিষয়ে কিছু করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ফলে ধরেই নেওয়া যায় যে শিল্প খাতের বিদ্যমান নীতিকাঠামোতে এ মুহূর্তে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। এর মানে হচ্ছে, শিল্প খাতের নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধির ধারা চলতি অর্থবছরে তো বটেই, আসন্ন অর্থবছরেও অব্যাহত থাকার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। তবে এর মধ্যেও শিল্প মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ও দেশপ্রেমিক দায়িত্বশীল আমলারা যদি সাহস করে এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক কিছু করতে উদ্যোগী হন, তাহলে প্রবৃদ্ধির উল্লিখিত নিম্নমুখী ধারা কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু তারা তা করতে কতটা আগ্রহী হবেন, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর এরূপ সন্দেহ পোষণের কারণ এই যে উপদেষ্টারা এই মুহূর্তে সময়ের দিক থেকে খুবই চাপের মধ্যে আছেন। আর আমলারা তা করতে আগ্রহী হবেন না কিছুটা স্বভাবগত এবং অনেকটাই ঐতিহ্যগত কারণে।

বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য বলি, দেশে যখন থেকে (বস্তুত ১৯৯১ সালের শিল্পনীতি থেকে) উৎপাদনশিল্পের তুলনায় সম্পূর্ণ অন্যায্যভাবে সেবা খাতকে অধিকতর অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়ে আসছে, তখন থেকে এ পর্যন্ত সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে খুব স্বাভাবিকভাবেই একাধিকবার রাজনৈতিক দলের পরিবর্তন ঘটলেও আমলাতন্ত্রের স্থায়ী সদস্যরা ঠিকই থেকে গেছেন। কিন্তু কই, তারা তো কেউই কখনো শিল্প খাতের এ অন্যায্যতার বিষয়টিকে রাজনীতিকদের সামনে তুলে ধরেননি! অতএব এখনো যে তারা একইভাবে নির্লিপ্ত থাকবেন, সে আশঙ্কাই সর্বাধিক। তারপরও যদি কোনো কোনো ঊর্ধ্বতন আমলা বিবেকের তাড়নায় এ ক্ষেত্রে প্রথা ভেঙে এগিয়ে আসতে আগ্রহী হন, তাহলে তাঁদের গৃহীত নীতিকাঠামো পরিবর্তনের উদ্যোগ শিল্প খাতে বিরাজমান নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধির ধারাকে কিছুটা হলেও রোধ করতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শিল্প খাতের নীতিকাঠামোগত এ পরিবর্তনগুলো কোথায় কোথায় আনা প্রয়োজন? জবাবে বলব, কাজটিকে দুই পর্যায়ে সম্পন্ন করা যেতে পারে। এক. এ খাতের প্রবৃদ্ধির ধারায় বর্তমানে যে নিম্নমুখিতা বিরাজমান রয়েছে, সেটিকে জরুরি ভিত্তিতে ঠেকাবার জন্য আপৎকালীন কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা; এবং দুই. রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনান্তে এ ক্ষেত্রে ব্যাপকভিত্তিক পরিবর্তন আনয়ন। উল্লিখিত দ্বিপর্যায়িক পরিবর্তন-উদ্যোগের আওতায় এই মুহূর্তের আশু করণীয় হিসেবে শিল্পের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনে সেবা খাতকে শিল্পের বাইরে নিয়ে যাওয়া, উৎপাদনশিল্পের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রদেয় নীতিসহায়তা ও প্রণোদনামূলক সুবিধাদিকে সেবা কার্যক্রম থেকে আলাদা ও অগ্রাধিকারমূলক করা এবং একইভাবে ব্যাংকঋণের ক্ষেত্রে সেবা খাতের তুলনায় উৎপাদন খাতের জন্য অধিকতর নমনীয় সুদহার ও শর্তাদি প্রবর্তন করা। অন্তর্বর্তী সরকার তথা শিল্প মন্ত্রণালয় আপাতত এ তিনটি উদ্যোগ নিয়েই আগানোর কথা ভাবতে পারে এবং তা করা সম্ভব হলে শিল্পে প্রবৃদ্ধির বর্তমানের নিম্নমুখী প্রবণতা অনেকখানিই রোধ হয়ে আসবে বলে আশা করা যায়। তদুপরি এ তিন উদ্যোগের ফলে উৎপাদন খাতে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই), পণ্য রপ্তানি, শিল্পপণ্যের মান ও উৎপাদনশীলতা ইত্যাদি প্রায় নিশ্চিতভাবেই বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা চলে।

অন্যদিকে রাজনৈতিক সরকার দায়িত্বে আসার পর দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী ভিত্তিতে যে কাজগুলো করা যেতে পারে, তার মধ্যে একেবারে প্রথমেই রয়েছে চলমান শিল্পনীতি ২০২২-এর সমুদয় খোলনলচে আমূল পাল্টে ফেলে একটি সম্পূর্ণ নতুন শিল্পনীতি প্রণয়ন করা, যার আওতায় শিল্প বলতে শুধু উৎপাদনশিল্পকেই বোঝানো হবে, যেমনটি বিবিএসের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক জরিপে বোঝানো হয়েছে। আর এটি করার মাধ্যমে দেশে একদিকে যেমন উৎপাদনশীল ভারী শিল্পের বহুমাত্রিক প্রসার ঘটানো সম্ভব হবে, অন্যদিকে তেমনি তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকেও একটি মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে সাহায্য করবে। আর মনে রাখা দরকার যে পৃথিবীতে বর্তমানে যারা অর্থনীতির পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত, তাদের সবাই বস্তুত শিল্পোন্নত দেশের সদস্য এবং সেখানে শিল্প বলতে স্পষ্টতই উৎপাদনশিল্প। ফলে বাংলাদেশ যদি নিজেকে পর্যায়ক্রমে শিল্পোন্নত বিশ্বের সারিতে শামিল করতে চায়, তাহলে এখন থেকেই তাকে উৎপাদনশিল্পের ভিত্তি যথেষ্ট দৃঢ় ও মজবুত করার জন্য উঠেপড়ে লাগতে হবে। আর উল্লিখিত নতুন শিল্পনীতি প্রণয়ন করার সময় সচেতনভাবে খেয়াল রাখতে হবে যে বিশেষ মহল এবং বিশেষ বিশেষ ব্যবসায়িক শ্রেণি ও গোষ্ঠীর স্বার্থের দিকে তাকিয়ে আবারও যেন সেবামূলক কর্মকাণ্ডকে শিল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা না হয়।

সব মিলিয়ে তাই বলব, বিবিএসের জরিপে শিল্প খাতের নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধির যে চিত্র ফুটে উঠেছে, অর্থনীতি তথা দেশের বৃহত্তর জনগণের স্বার্থে সেটি রোধ করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, এর নেতিবাচক প্রভাব শেষ পর্যন্ত শুধু শিল্প খাতের মধ্যেই সীমিত থাকবে না। বরং এর সুতার টান (চেইন অ্যাফেক্ট) ক্রমান্বয়ে অন্যান্য খাতেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে যাবে এবং প্রকারান্তরে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকেও প্রচণ্ডভাবে ভোগাবে। আর সে ভোগান্তির আওতায় নতুন বিনিয়োগ, উৎপাদন, রপ্তানি, কর্মসংস্থান, মজুরি ইত্যাদি হ্রাস পাওয়ার মতো বিষয়গুলো যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে দ্রব্যমূল্য ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোও।

আর এসব ঘটলে অনিবার্যভাবেই তা দেশের জিডিপি, মাথাপিছু আয়, দারিদ্র্য পরিস্থিতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য তথা সার্বিক মানব উন্নয়ন সূচককেই ব্যাপক ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে বইকি! ফলে সে রকম একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করার জন্য অন্যান্য খাতের পাশাপাশি শিল্প খাতকে অবশ্যই আবার ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে হবে, যার জন্য এই প্রবন্ধে উপস্থাপিত প্রস্তাবসমূহকে বিবেচনায় নিলে কিছুটা হলেও সুফল মিলতে পারে বলে আশা করা যায়।

লেখক: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন, শিল্প মন্ত্রণালয়

সংকটেও ভালো থাকুক বাংলাদেশ

মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা নিয়ে কথা

পাঠকের লেখা: বিজয় অর্জনের গৌরব

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি

অসময়েই শত্রু-মিত্র, মীরজাফর ও বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়

খেলা কি তবে এবার মুখ ও মুখোশের

বুদ্ধিজীবী দিবস যেন ভুলে না যাই

উড়োজাহাজগুলোও পরিবেশের ক্ষতি করছে

যে প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে হবে