হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

জনগণের মনে রয়েছে প্রশ্ন, উত্তর নেই কোথাও

জাহীদ রেজা নূর

দেশ কোন পথে যাত্রা করেছে, তা নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে দেশের জনগণ। এক বছর আগে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে ঐক্য দেখা দিয়েছিল, এখন সেই ঐক্যের ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। বিভিন্ন দল তাদের নিজেদের পথ বেছে নিয়েছে। একে অন্যের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে বিভিন্ন দল বিভিন্ন অবস্থান নেওয়ায় আদৌ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। এর ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশাল ধাক্কা! ৩৫ শতাংশ শুল্কের বাড়তি চাপের বোঝা মাথা থেকে নামানোর জন্য কোনো গোপন চুক্তি হচ্ছে কি না, তা নিয়েও জনমনে সংশয় রয়েছে। ‘পাবলিক’ তার নিজের মতো করেই অনেক ঘটনা বুঝে নেয়। মার্কিনরা কী চাইতে পারে, তা নিয়েও তারা তাদের মতো করেই কিছু জবাব তৈরি করে নিয়েছে। মার্কিনদের কাছে দেশ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে না তো?—এমন প্রশ্নও উঠছে আড্ডায়।

রাজনীতির মাঠ মোটেই মসৃণ নয়। সব সময় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে একই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ তাতে নেই। দেশের পরিবর্তিত অবস্থায় কীভাবে জনমত গঠন করা যায় কিংবা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তার কৌশল নির্ণয় করার মধ্যে রাজনৈতিক ক্যারিশমার প্রকাশ ঘটে। এক রাজনৈতিক দল অন্য রাজনৈতিক দলের দোষ-ত্রুটি নিয়ে কথা বলবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই কথা বলতে গিয়ে মিথ্যাচার করা হলে সেটা রাজনীতিকে কলুষিত করে। এই কলুষতার বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে বিস্তর।

২.অনেকের মনেই প্রশ্ন, বিএনপি কি সত্যিই ফাঁদে পড়েছে? জুন মাসের মাঝামাঝি লন্ডনে ‘ইউনূস-তারেক বৈঠক’টি কি আসলেই ছিল এক পরিহাস? প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরের উদ্দেশ্য নিয়েও সে সময় প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকে। অনেকেই মনে করেছেন, মূলত তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করার জন্যই ছিল এই সফর। এ বছর ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে—বিএনপি এ রকম একটি কঠোর অবস্থান থেকে সরে গেল ওই বৈঠকের পর। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে আদৌ নির্বাচন হবে কি না, তার অঙ্গীকার করলেন না প্রধান উপদেষ্টা। বরং বিচার-সংস্কার ইত্যাদির কিছু শর্ত দিয়ে এক ম্যাজিক রিয়ালিজমের দিকে নিয়ে গেলেন পরিস্থিতি।

এর ফল ফলল দুই রকম। বিএনপি প্রচার করতে লাগল, সমস্যার একটা সমাধান হয়েছে। জামায়াত আর এনসিপি এই বৈঠক নিয়ে প্রশ্ন তুলতে লাগল। কিন্তু আদতেই নির্বাচন কবে হবে, সে বিষয়ে ধোঁয়াশা দূর হলো না। একসময় মনে হয়েছিল, বিএনপি আর এনসিপির মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে কোনো আলোচনার জন্ম হবে। কিন্তু দেখা গেল, বিএনপির সঙ্গে জামায়াত আর এনসিপির মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হলো। এনসিপির নেতারা বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। বিএনপিকে মুজিববাদের নতুন পাহারাদার বলেও তাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ আনা হয়েছে।

আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বিএনপি ভেবে নিয়েছিল, তারাই চলে এসেছে ক্ষমতায়। কিন্তু দেশের সর্বত্রই দেখা গেল ক্ষমতায় না আসা বিএনপির লোকেদের দখলদারি আর লুটপাট। বিভিন্ন জায়গায় তাদের পেশিশক্তির আভাস দেখা দিল। ক্ষমতায় আসার আগেই এ ধরনের আচরণ করায় বিএনপির ওপর জনগণের আস্থা কিছুটা কমেছে, এ কথা বললে ভুল বলা হবে না। অন্যদিকে, গ্রেনেড হামলা মামলায় খালাসপ্রাপ্ত তারেক রহমানসহ অনেক বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে সরকারপক্ষ থেকে আপিল করা হচ্ছে, তাতে বিএনপি নেতা দেশে ফিরবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। লন্ডনে বসে ঢাকা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়। সম্ভবও নয়। তাই বিএনপি কোনো দুর্দশার মধ্যে পতিত হচ্ছে কি না, সেটা নিয়ে এখন বিএনপির নেতা-কর্মীরাও ভাবছেন।

৩. সম্প্রতি মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ হত্যা নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাদের দিকেই উঠেছে অভিযোগের আঙুল। কিন্তু জনমানুষের একটি অংশ মনে করছে, এই হত্যাকাণ্ড রহস্যময়। এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হতে পারে। যদি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে, তাহলে কারা এর পরিকল্পনাকারী? কেন এই পরিকল্পনা? দেশের আইনশৃঙ্খলার অবস্থা ভালো নয়, এটা প্রমাণ করে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা নয়তো? এ রকম নৃশংসতা তো সচরাচর দেখা যায় না। যারা সোহাগকে হত্যা করেছে, তারা কতটা পাশবিক আচরণ করেছে, সেটা ভিডিও ফুটেজ দেখলেই বোঝা যায়। কয়েকজন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। যেই লোকটি সোহাগের মাথা থেঁতলে দিয়েছিল, পটুয়াখালীর সদর উপজেলার ইটবাড়িয়া এলাকা থেকে সে গ্রেপ্তার হয়েছে ১৫ জুলাই গভীর রাতে। এই দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে জানতে হবে এই নৃশংসতা কেন ঘটানো হলো এবং এর পরিকল্পনাকারী কারা? তাদের আনতে হবে আইনের আওতায়। সমস্যা হচ্ছে, এ রকম কথা অনেক বলা হয়। কিন্তু এদের বিচার বা শাস্তি খুব একটা হয় না। নাটের গুরু কারা, তাদের কথাও জানতে পারে না কেউ।

৪. দেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় নির্বাচন কবে হবে, সে ব্যাপারে কিছুই বলতে পারেননি। প্রধান উপদেষ্টার বিভিন্ন সময়ের কথাবার্তা থেকে যা বোঝা গেছে, তাতে মনে হয়, তিনি মূলত এপ্রিলের দিকেই নির্বাচন চাইছেন। তবে তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তারিখটি এগিয়ে আনার গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল। তাই ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিলের কোনো একটি দিনকে নির্বাচনের দিন হিসেবে ধরে নিয়েই নিজেদের কাজ শুরু করতে পারে নির্বাচন কমিশন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ঘাড়ে এবার গুরুভার বর্তেছে। পূর্ববর্তী দুই প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে যেভাবে জনসমক্ষে হেনস্তা করা হয়েছে, সেটা যদি তিনি মনে রাখেন, তাহলে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না দিলে তাঁর পরিণতি কী হবে, তা নিশ্চয়ই তিনি বুঝতে পারছেন। পুলিশের সামনেই একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছে, তাঁর গালে চপেটাঘাত করা হয়েছে, অথচ সামনে থাকা পুলিশ সে সময় ‘নিরপেক্ষ বা নির্বিকার’ ভূমিকা পালন করেছে। অর্থাৎ আইনের রক্ষকেরাও অনেক সময় নীরব থাকতে পারেন, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। তা নিয়ে সমালোচনা করা যায় বটে, কিন্তু অপমানটা হজম করে নিতে হয়। অন্যায় করলে আইনের হাতে সোপর্দ করার আগেই জনতার হাতে নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা এত বেশি ঘটছে যে, সামাজিক সম্পর্কগুলোই বদলে গেল কি না, সে প্রশ্নও জেগেছে অনেকের মনে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে বলেছেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে সরকারের কাছ থেকে কোনো গাইডেন্সও নাই, পরামর্শও নাই, আদেশও নাই, নির্দেশও নাই, নাথিং। আমরা অ্যাবসোলিউটলি ইনডিপেন্ডেন্টলি এই প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ নিজেরাই প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সেটা খুব ভালো কথা। কিন্তু জনগণকে তো এ ব্যাপারে কিছু বার্তা দিতে হবে। প্রথমত, প্রধান উপদেষ্টা বিদেশে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘তুমি টাকা দাও, আমি ভোট দেব। দেশে ভোটের চর্চা সেটাই।’ —অর্থাৎ এই দেশের মানুষ টাকা খেয়ে ভোট দেয়। প্রধান উপদেষ্টার এই কথা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। দেশের জনগণ ক্ষমতার উৎস হলেও ভোটের সময় তারা রাজনৈতিক দলের কাছে বিক্রি হয়ে যায়, এ রকম কথা মেনে নেওয়া একটু কঠিন বটে। প্রধান উপদেষ্টার কথার ভিত্তি আছে বলে যদি মনে করে থাকে নির্বাচন কমিশন, তাহলে সংস্কারটা তো এমন হতে হবে যেন কেউ টাকা খেয়ে ভোট দিতে না আসতে পারে। নইলে একটি ভালো নির্বাচন তারা করবে কী করে?

এ সময়ে যিনি প্রথমবারের মতো ভোট দিতে যাবেন, তাঁকে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন? তাঁকে সচেতন করার জন্য কী কী পরিকল্পনা রয়েছে তাদের? তফসিল ঘোষণার পর কত দিনের মধ্যে কমিশন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে পারবে? নির্বাচনী প্রশাসন যেন দলীয়করণ না হয়, তা নিশ্চিত করবে কীভাবে? এ রকম বহু প্রশ্ন আছে, যার উত্তর খুঁজতে হবে। যেহেতু বহুদিন পর একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার করা হচ্ছে, সেহেতু পান থেকে চুন খসলেই সবকিছু বরবাদ হয়ে যেতে পারে—এ কথা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মনে রাখা উচিত।

৫. নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে কঠোর না হলে সামনে আরও বিপদ আছে। নতুন বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখেছিল দেশের জনগণ, সেই স্বপ্নের কতটা এখনো হৃদয়ে জাগরূক আছে আর কতটা হতাশা এসে গিলে খেয়েছে, তা নিয়েও জনগণের মনে প্রশ্ন আছে। আন্দোলনে অংশ নেওয়া তরুণদের থোড়াই কেয়ার করে তরুণ প্রজন্মের কেউ কেউ হঠাৎ করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে, এমন ফিসফিস আলোচনাও শোনা যায় চায়ের দোকানের আড্ডায়। মানুষ সহজেই ভুলতে চায়। নতুন কিছু নিয়ে মেতে থাকতে চায়। কিন্তু নতুন কিছু গড়ে ওঠার অঙ্গীকারের মধ্যে ফাঁকি দেখলে মানুষ হতাশ হয়। সেই হতাশা মনে বেদনার জন্ম দেয়। সেই বেদনায় মানুষের মনের আশা ভঙ্গ হয়। আর আশা ভঙ্গ হলে মানুষ তা থেকে মুক্তি খোঁজে। বুদ্ধিমান নেতা মানুষের সেই মানসিক অবস্থাকে আমলে নেন। তিনি মানুষের ভাবনাকে সম্মান করেন। আর যদি তিনি তা না করেন, তবে তিনি পরিণত হন স্বৈরাচারে। জনগণ তখন সেই নেতার বিবেচ্য বিষয় আর থাকে না।

আমরা আসলে আত্মজিজ্ঞাসার যে ক্রসরোডে এসে দাঁড়িয়েছি, তাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ভুল করার আর সুযোগ নেই। দেশের দলমত-নির্বিশেষে তরুণেরা আশার বাণী শোনাতে পারবে কি না, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। দলবাজ তরুণ নয়, মুক্তির দিশা রচনাকারী তরুণদের দিকেই তাকিয়ে আছি আমরা।

লেখক:– উপসম্পাদক আজকের পত্রিকা

শঙ্কা যেন পিছু ছাড়তে চাইছে না

হাদি হত্যা এবং আগামী নির্বাচন

দেশের অর্থনীতির দ্বৈত বাস্তবতা

এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাস ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না কেন

ভারতজুড়েই কি ফুটবে পদ্মফুল

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

সমুদ্রস্তরের উত্থান ও দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা

সংকটেও ভালো থাকুক বাংলাদেশ

মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা নিয়ে কথা