বরফরাজ্য অ্যান্টার্কটিকা পাড়ি দেওয়া মোটেই সহজ কাজ নয়। তারপর যদি যাত্রাটা হয় একাকী, তাহলে তো কথাই নেই। কিন্তু ১৯৯৭ সালের এই দিনে একাকী এবং কারও সাহায্য ছাড়া প্রথম মানুষ হিসেবে অ্যান্টার্কটিকা জয় করেন নরওয়ের বোর্জ অসল্যান্ড।
বোর্জ অসল্যান্ডের প্রথম অ্যান্টার্কটিকা পাড়ি দেওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সেবার ৬২০ মাইলের বেশি পাড়ি দেন তিনি। তবে মহাদেশের শেষ প্রান্তে পৌঁছানোর বহু আগেই ফ্রস্টবাইটে (অস্বাভাবিক ঠান্ডায় শরীরে সৃষ্টি হওয়া জখম) প্রবলভাবে আক্রান্ত হওয়ার কারণে ফিরে আসতে হয় তাঁকে।
তবে হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নন বোর্জ অসল্যান্ড। পরের বছর আবার চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। উপকূল ধরে অ্যান্টার্কটিকার শেষ মাথায় পৌঁছাতে চাইলেন তিনি। বাইরের কোনো সহায়তা ছাড়া একাকী অ্যান্টার্কটিকা জয়ের সংকল্প নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন ১৯৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর।
বারকনার দ্বীপের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন অসল্যান্ড। সামনে ধীরে ধীরে উঠে যাওয়া বরফের এলাকা দেখে মনে হলে পথের কোনো শেষ নেই। অসল্যান্ডের কাছে এ ধরনের কোনো অভিযানের শুরুটাই গোটা অভিযানে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিগুলোর একটি। বরফরাজ্যে প্রথম কিছুটা পথ এগোনো আসলেই কঠিন। মোটামুটি ১০ থেকে ১৪ দিন লাগে এই বৈরী পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে।
উড়োজাহাজ কিংবা হেলিকপ্টার থেকে তোলা ছবি দেখে অ্যান্টার্কটিকা জয়ের একটি সম্ভাব্য পথ ঠিক করেন অসল্যান্ড। এটি তাঁকে পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার পেনসাকোলা পর্বতমালার ডুফেক ম্যাসিফ ধরে নিয়ে যাবে।
দক্ষিণ মেরুর বেস ক্যাম্প একটি লোভনীয় ফাঁদ হতে পারে—জানেন অসল্যান্ড। তাই সেখানে না থামার সিদ্ধান্ত নিলেন। একবার ভেতরে ঢুকে আরাম বোধ করলে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।
দক্ষিণ মেরুর চারপাশের মালভূমি শীতল, উচ্চতাও বেশি। তবে এখানে বাতাস তুলনামূলক কম। পর্বত এলাকার কাছাকাছি এলে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসা প্রবল বাতাসের মুখোমুখি হতে হয়। অবশ্য অসল্যান্ড এই বাতাসকে উল্টো কাজে লাগান। একধরনের ঘুড়ির সাহায্যে বাতাসের সহায়তা নিয়ে দ্রুতগতিতে মাইলের পর মাইল স্কি করে যান তিনি। তবে বাধা সৃষ্টি করে পথে জমা বরফের স্তূপগুলো।
প্রবল গতিতে চলার সময় আচমকা কোনো একটায় হোঁচট খেয়ে পা ভাঙার আশঙ্কা প্রবল। আর একাকী এই অভিযানে এমন দুর্ঘটনার একটাই অর্থ—নিশ্চিত মৃত্যু।
দুপাশের পর্বতরাজ্যের মাঝখান দিয়ে যাওয়ার জন্য এক্সেল হোইবার্গ হিমবাহের পথ ধরার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারপর ধরবেন বায়েরডমোর হিমবাহের পথ। এদিক দিয়ে গেলে কিছু ফাটল থাকলেও তুলনামূলক নিরাপদ পথটি। ১৯১১ সালে বিখ্যাত অভিযাত্রী অ্যামুন্ডসেন এই পথ ধরেছিলেন।
এক্সেল হেইবার্গ হিমবাহের পাদদেশে বরফের বিশাল একটি তাক আছে। এটি রস আইস শেলফ নামে পরিচিত। অসল্যান্ডকে এক বিজ্ঞানী বলেছিলেন এই বরফ তাকের বয়স এক লাখ বছর।
অ্যান্টার্কটিকার শেষ প্রান্ত স্কট বেসে অসল্যান্ড পৌঁছান ১৯৯৭ সালের ১৮ জানুয়ারি। আগের বছরের ১৫ নভেম্বর শুরু করা ওই যাত্রায় তিনি পেরোন ১ হাজার ৮৬৪ মাইল। সৌভাগ্যক্রমে স্কট বেসের ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সময় সেখানে পৌঁছান তিনি। প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী স্যার এডমন্ড হিলারিও ছিলেন এ উপলক্ষে সেখানে। হিলারির সঙ্গেই হেলিকপ্টারে চেপে দক্ষিণ মেরু যান অসল্যান্ড। পরে অসল্যান্ড বলেন, ‘যে দূরত্ব পেরোতে আমার এক মাসের বেশি লাগল, সেটা উড়ে গেলাম আড়াই ঘণ্টায়।
অবশ্য অসল্যান্ডের যাত্রা ১৮ জানুয়ারি শেষ হয়, নাকি ১৭ জানুয়ারি—এটি নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ও অনেক গণমাধ্যম যাত্রাটি ১৮ জানুয়ারি শেষ হয় বলে উল্লেখ করলেও গার্ডিয়ানের এক লেখায় অসল্যান্ড তারিখটা ১৭ জানুয়ারি বলে উল্লেখ করেন।
অসল্যান্ডের ওই অভিযানকে দেখা হয় কোনো সাহায্য ছাড়া প্রথম একাকী কারও অ্যান্টার্কটিকা বিজয় হিসেবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক কলিন ও’ব্রেড ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অ্যান্টার্কটিকা জয়ের পর দাবি করেন, তিনিই প্রথম মানুষ হিসেবে কোনো ধরনের সহায়তা ছাড়া একাকী অ্যান্টার্কটিকা জয় করেন। অনেকে তাঁর দাবিটাকে গুরুত্বও দেন। কারণ তিনি তাঁর স্লেজটা নিজেই টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন গোটা যাত্রাপথে। অন্যদিকে অসল্যান্ড একটি ঘুড়ি ব্যবহার করে বাতাসের সাহায্যে এগিয়েছিলেন।
সূত্র: গার্ডিয়ান, ডিসকভারি.কম, উইকিপিডিয়া