হোম > জীবনধারা > ভ্রমণ

বন্য কুকুর আর ভালুকের বন সাতছড়ি

ইশতিয়াক হাসান

নানার বাড়ি মাধবপুরের ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা গ্রাম দেবনগরে। ওখান থেকে পাশের উপজেলা চুনারুঘাটের সাতছড়ি সোয়া ঘণ্টা বা দেড় ঘণ্টার পথ। দেবনগরে গেলে তাই সাতছড়ি না গেলে যেন চলেই না। আজকের গল্পটা সাতছড়ির। তবে এবারের ভ্রমণকাহিনিটি শুরুর আগে বরং কীভাবে এই বনটির প্রতি আগ্রহের শুরু সেটা বলি।

স্কুলে পড়ি তখন। সেজ মামা রফিকুল আলম একদিন কথায় কথায় বললেন, ঢাকা-সিলেটের রাস্তাটা চুনারুঘাটের একটা বনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে। আগে রাতের বেলায় গাড়ির হেডলাইটের আলোয় সেখানে দেখা যেত চিতা বাঘের গায়ের ফোঁটা কিংবা জ্বলতে থাকা চোখ। কখনো কখনো গাড়ি দেখে অজানা প্রাণী ঠাউরে থাবা চালিয়ে গ্লাস ভেঙে দিয়েছে চিতা বাঘ এমন নজিরও আছে। ওই পথে যাওয়ার সময় আঁধার নেমে গেলে সাহসী চালকেরাও তাই প্রমাদ গুণতেন। 

অনেক বছর পর অনার্সে পড়ার সময় একবার নানার বাড়িতে গেলে মামার থেকেই জানতে পারি ওই বনটির নাম সাতছড়ি। মামা আফসোস করে বলেন, ‘এক সময় শুধু চিতা বাঘ না গবইও (বন গরু) ছিল ওই বনে। এখন আর নাই। ঢাকা-সিলেটের বাস ওই পথে যায় না, নতুন বড় রাস্তায় যায়। তবে লোকাল বাস চলে।’ 
 
সেই সূত্রে সেবারই প্রথম যাই সাতছড়ি। এবারের গল্পটা অবশ্য সাম্প্রতিক। গিয়েছি নানার বাড়ি থেকেই। সঙ্গে ছিল স্ত্রী পুনম, মেয়ে ওয়াফিকা আর খালামণি বদরুন নাহার সেলিনা। একটি সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করেছিলাম। প্রথম পৌঁছালাম নয়াপাড়ার তেমুন্যায়। তারপর ডানের একটা পথ ধরল আমাদের গাড়ি। 

তেলিয়াপাড়ার কাছাকাছি ভূ-প্রকৃতি বদলে গেল, রাস্তার দুই পাশে গাছপালা, ছোট ছোট টিলা। তারপরই ঢুকে পড়লাম আশ্চর্য সুন্দর এক চা বাগানের এলাকায়। ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি ছড়া। বর্ষা মৌসুম না হওয়ায় পানি কম, কোথাও বালুর রাজ্য। বাগানের ভেতর হঠাৎ হঠাৎ ঢুকে পড়েছে সরু পথ। ইচ্ছা হচ্ছিল হারিয়ে যেতে সুদূরে, ওই মাটির পথ ধরে। আমার জানা আছে, এটা সুরমা চা বাগান। পাশেরটা সাতছড়ি চা বাগান।

এক সময় পৌঁছে গেলাম সাতছড়ির সীমানায়। অটোরিকশা রেখে চওড়া একটা বুনো জন্তু চলাচলের পথ ধরে ঢুকলাম বনে। সাতছড়িতে এলে এ পথটায় আমার একবার ঢুঁ মারা চাই-ই চাই। আগেই জানিয়ে যাওয়ায় বিট কর্মকর্তা সঙ্গী হিসাবে দিলেন একজন ফরেস্ট গার্ডকে। মধ্যবয়সী হাসি-খুশি এক মানুষ।

সাতছড়ির ভেতরে ত্রিপুরাদের কিছু বসতি আছে, যেমন চোখে পড়ে রেমা-কালেঙ্গায়ও।

পথটা একটু নিচু, দুই পাশের জমির তুলনায়। শীত ও গ্রীষ্মে বেশ বালুময় থাকে। ওই পথে চলতে চলতে গল্প চলল সঙ্গের বন প্রহরীর সঙ্গে। বালুতে মায়া হরিণ আর মেছো বিড়ালের পায়ের ছাপ দেখলাম।  পথের ডানে বিশাল সব গাছ দেখে চোখ টাটাল। আকাশছোঁয়া চাপালিশ আছে বিস্তর। চাপালিশের কাঁঠালের মতো দেখতে, তবে আকারে ছোট ছোট ফল পড়ে আছে বালু মাটিতে। ওয়াফিকা তো বলেই বসল, বাপি কাঁঠাল এত ছোট কেন?

ভালুক আছে সাতছড়িতে। হঠাৎ হঠাৎ এগুলোর সামনে পড়ে যায় বনে কাজ করতে যাওয়া কেউ কেউ। বাম পাশের গুল্ম আর ঝোপের জঙ্গল পেরিয়ে দেখা পেলাম বানরের দলের। বনের আরও গভীরে যেতেই লম্বা একটা গাছের নিচে প্রথম লম্বা লেজটা দেখি, তারপর ঠিক নিচে গিয়ে দাঁড়াতেই পাতার রাজ্যের ফাঁক গলে দেখা গেল মুখে ভুসো কালি মেখে রাখা মুখপোড়া হনুমান। দলে সদস্য সংখ্যা ছয়-সাত।

বালুর ওপর পাতা বিছানো পথে হাঁটতে মচ মচ শব্দ হচ্ছে। অবশ্য বুনো জন্তুর দেখা পেতে চাইলে শব্দ কম করাটাই উত্তম। বনের ভেতরে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া সাতটি ছড়া বা ছড়ি থেকে নাম সাতছড়ি। শীতে ওই শুকনো, বালুময় ছড়াপথে হাঁটা যায় ইচ্ছামতো। 

মায়া হরিণের একটা ডাক শুনলাম। সঙ্গীদের দাঁড় করিয়ে ডাকটা অনুসরণ করে চলে গেলাম একেবারে ওর আস্তানা পর্যন্ত। সাতছড়ি সবচেয়ে পছন্দ পাখিপ্রেমীদের। টিয়া আর লম্বা লেজের ভীমরাজ দেখলাম। একটা বন মোরগে আধা দৌড় আধা উড়ে চলে গেল সামনের দিয়ে। 
 
সাতছড়িতে বানর দেখার আদর্শ জায়গা আমার মতে, চুনারুঘাটের দিকে যাওয়া রাস্তার বাম পাশের পাম বাগান। ওই জায়গাটা পড়েছে যদ্দুর জানি তেলমেছড়া বিটে। ওখানে কয়েক শ বানরের একটা দল দেখেছিলাম একবার। একটার গায়ে কে যেন মজা করে লাল জামা পরিয়ে দিয়েছিল। সেই লাল জামা পরে সঙ সাজা বেচারার সে কী ছোটাছুটি। সাতছড়ির ন্যাশনাল পার্ক অংশেও প্রচুর বেত ঝাড়, অর্কিডের দেখা মেলে। শুনেছি তেলমেছড়ায়ই নাকি ভালুকদের ঘাঁটি। ভালুকের মেজাজ-মর্জি বোঝা মুশকিল, তাই তেলমেছড়ায় ঘুরলাম খুব সাবধানে। 

দীর্ঘ ঘোরাঘুরির ইতিহাসে সাতছড়িতে ঢোল বা বন্য কুকুরদের থাকার দু-একটা গুজব শুনলেও উড়িয়ে দিয়েছিলাম। তিন গবেষক মুনতাসির আকাশ, তানিয়া জাকির ও হারিশ দেববর্মা সাতছড়িতে ক্যামেরা ট্র্যাপে ঢোলদের বন্দী করে নিশ্চিত করেছেন কিছু কিছু গুজব সত্যিও হয়। 

ভারতের বারোমুরা হিলের সবচেয়ে উত্তর-পুবের সীমানায় রঘুনন্দন হিল রিজার্ভের অংশ এই সাতছড়ি। ওপাশটা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে, ওদিকটাও জঙ্গলাবৃত। বাংলাদেশ-ভারত মিলিয়ে একেবারে ছোট বন বলা যাবে না, অনেক বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। 

যাক আমাদের সেদিনের জঙ্গলের ভ্রমণ শেষ হলো ছোট্ট একটা ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে। খালামণি একটু উঁচু একটা ঢাল বেয়ে নামতে গিয়ে পা পিছলালেন। তারপর তাঁর পক্ষে আর জঙ্গলে হাঁটা কঠিন হওয়ায় আমরা ফিরে এলাম। অবশ্য এর আগে জঙ্গল দেখা হয়ে গেছে অনেকটাই। 

কী করবেন না
সাতছড়িতে ঘুরে বেড়াবার সময় অনেকেই ভুলে যান এটা বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। গতবার গিয়েও দেখেছি অনেকে জঙ্গলে ঢুকে হইচই করছেন। বনপথে পড়ে আছে চিপস-বিস্কুটের প্যাকেট। এ কাজগুলো করা উচিত নয়। আমাদের বাসায় ঢুকে যদি কেউ এমন হই চই করে কেমন লাগবে বলুন তো? বন আবর্জনাময় করার কোনো অধিকারও আমাদের নেই। 

জেনে রাখুন
জঙ্গলের যেখানটায় বন বিভাগের অফিস সেখানে প্রায়ই ফল খাবার লোভে হাজির হয়ে যায় মুখ পোড়া হনুমানের দল। ওখানে গেলে সহজেই পেয়ে যেতে পারেন এদের। সাতছড়ির আগে এবং পরে অনেকই চা বাগান আছে। জঙ্গলের পাশাপাশি বোনাস হিসাবে ঢুঁ মারতে পারেন ওগুলোতেও। ওয়াচ টাওয়ারটিতে উঠলে আশপাশের বেশ অনেকটা বন নজরে চলে আসবে।

কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সিলেটগামী শ্যামলী, হানিফ, এনা, মামুনসহ অন্য যে কোনো পরিবহনের বাসে ওঠে নেমে পড়বেন শায়েস্তাগঞ্জ কিংবা মাধবপুরের জগদীশপুরে। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশা রিজার্ভ করে চলে যেতে পারেন সাতছড়িতে।

আবুধাবি ভ্রমণের আগে যা জানা জরুরি

২০২৬ সালের জন্য এয়ারবিএনবি-এর পূর্বাভাস

পর্যটকের স্রোতে বিপর্যস্ত শহর

বিমানযাত্রার অলিখিত নিয়মগুলো জেনে নিন

রহস্যময় আগুন পাহাড়

ভিয়েতনামের পর্যটনশিল্প পুনরুদ্ধারের গতি দ্রুত

চীনে বাড়ছে ঘোড়ায় চড়ে ছুটি কাটানোর প্রবণতা

এআই-নির্ভর ভ্রমণে শীর্ষে ভিয়েতনাম

আন্তর্জাতিক পর্যটনে শীর্ষে ব্যাংকক, আকর্ষণীয় শহর প্যারিস

জেনে নিন মালদ্বীপ ভ্রমণের সেরা সময় কখন