ইসলামের ইতিহাসের এক গভীর শোকের মাস হলো মহররম। এই মাসের দশম দিন ‘আশুরা’ মুসলিম জাতির হৃদয়ে বহন করে এক গাঢ় স্মৃতি, করুণ ইতিহাস ও চেতনার মশাল। আর এই দিনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে কারবালার প্রান্তরে হুসাইন ইবনে আলী (রা.)-এর শাহাদাত। মহররম, আশুরা ও কারবালা—এই তিনটি শব্দ যেন ত্যাগ, সত্য এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
মহররমের তাৎপর্য
মহররম ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। এটি চারটি পবিত্র মাসের (আশহুরে হুরুম) একটি, যাকে আল্লাহ তাআলা সম্মানিত ঘোষণা করেছেন। (সুরা তওবা: ৩৬)। রাসুলুল্লাহ (সা.) মহররম মাসকে ‘আল্লাহর মাস’ বলে অভিহিত করেছেন। এ মাসে নফল রোজা রাখা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।
আশুরার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
আশুরা, অর্থাৎ মহররমের ১০ তারিখ ইসলামি ও পূর্বধর্মীয় ইতিহাসে বহু তাৎপর্যময় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। বলা হয়, এ দিনই মুসা (আ.) ফেরাউনের জুলুম থেকে বাঁচেন, এ দিনই নুহ (আ.)-এর কিস্তি নিরাপদ স্থানে নোঙর করে, আদম (আ.)-এর তাওবা কবুল হয় ইত্যাদি। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে আশুরা অমর হয়ে আছে হুসাইন (রা.)-এর কারবালার শাহাদাতের কারণে।
কারবালা: এক আত্মত্যাগের উপাখ্যান
হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম, ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ। কারবালার প্রান্তর, বর্তমান ইরাক। ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার রাজনৈতিক নিপীড়ন, জুলুম আর ইসলামের মূল চেতনাকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে হুসাইন (রা.) দৃঢ় প্রতিবাদ জানান। তিনি ইয়াজিদের বায়াত গ্রহণ না করে সত্যের পথে অটল থাকেন। মদিনা থেকে মক্কা, মক্কা থেকে কুফা—শেষতক কারবালার পথে যাত্রা করেন।
কারবালায় হুসাইন (রা.) পরিবার ও সঙ্গীসাথিসহ মাত্র ৭২ জন। ইয়াজিদের সেনাবাহিনী ছিল হাজার হাজার। ইয়াজিদের বাহিনী পানির উৎস ফোরাত নদী বন্ধ করে দেওয়া হয় হুসাইন (রা.) ও তাঁর সঙ্গীদের জন্য। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় জর্জরিত অবস্থায় হুসাইন (রা.), তাঁর শিশুসন্তান, ভাইসহ সবাই একে একে শাহাদাত বরণ করেন। নারীরা বন্দী হন।
কারবালার শিক্ষা
হুসাইন (রা.) জয়ের জন্য কারবালা যাননি। তিনি গিয়েছিলেন সত্যকে রক্ষা করতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে। তাঁর জীবনের মূল বার্তা—সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মত্যাগ করো, তবু অন্যায়ের সঙ্গে আপস করো না।
মহররম শুধু শোক বা রীতির মাস নয়; এটি চেতনার মাস, আত্মবিশ্লেষণের মাস। আশুরা শুধু কাঁদার দিন নয়; ইসলামের সত্যরূপ ধরে রাখার শপথের দিন। কারবালার ঘটনা মুসলিম উম্মাহকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়—সত্য কখনো একা নয়, সে হয় শ্রেষ্ঠতম। হুসাইন (রা.) শহীদ হয়েছেন, কিন্তু তাঁর আদর্শ অমর আছে।