পশ্চিম তীরের রামাল্লা কালচারাল সেন্টার তখন আবেগের মহামঞ্চ। এক দিকে ২৪ বছর পর মায়ের কোলে ফেরা সন্তান, অন্য দিকে প্রিয়জনের মুক্তি না পাওয়ায় বোনের বুকফাটা আর্তনাদ!
সোমবার দুপুরের রামাল্লা কালচারাল সেন্টারের বাতাস ছিল উত্তেজনায় থমথমে, যেন কয়েক দশকের কান্না ও প্রতীক্ষা জমাট বেঁধে আছে। ইসরায়েলি কারাগার থেকে ফিলিস্তিনি বন্দীদের নিয়ে আসা বাসের বহর যখন থিয়েটারের সামনে এসে থামল, মুহূর্তের মধ্যে উত্তেজনা রূপ নিল বাঁধভাঙা জোয়ারে। পুলিশের তৈরি ব্যারিকেড ভেঙে শত শত মানুষ ছুটে গেল বাসের জানালার দিকে। প্রতিটি মুখ খুঁজছিল বছরের পর বছর হারানো প্রিয়জনকে। অনেকের ঠোঁটে ছিল প্রিয়জনের নাম ধরে চাপা স্লোগান—নাম ধরে ডাকা সেই মানুষটিকে, যাকে তাঁরা হয়তো এক দশক দেখেননি।
জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসা ক্লিষ্ট মুখগুলো দেখে স্বজনেরা সহজে চিনতে পারছিলেন। কারণ এই মুখগুলোই তাঁদের বহু বছরের স্বপ্নের সঙ্গে মিলছিল না। মুক্তি পাওয়া বন্দীদের অনেকের গালে এখনো সদ্য সেরে ওঠা আঘাতের চিহ্ন—কারাগারের ভয়াবহতার নীরব সাক্ষী। দীর্ঘ কারাবাসের কারণে তাঁদের চেহারায় এক অস্বাভাবিক কাঠিন্য এসেছে।
ভিড়ের মধ্যে থেকে মুক্তি পেয়ে এগিয়ে এলেন সাবের মাসালমা। ফিলিস্তিন মুক্তি সংগঠন (পিএলও) ফাতাহ-এর এই সদস্য চব্বিশটি বছর ধরে কারাগারের নিকষ অন্ধকারে ছিলেন। ষড়যন্ত্র ও প্রাণঘাতী হামলার অভিযোগে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সাবেরকে বহনকারী বাস থেকে নামিয়ে কাঁধে তুলে নিল স্বজনেরা, যেন সদ্য মুক্ত হওয়া এক বিজয়ী বীর। পরনে ফিলিস্তিনি কেফিয়াহ, দুই আঙুল তুলে দেখাচ্ছিলেন বিজয় চিহ্ন।
কিন্তু সেই বিজয়ের মুহূর্তেই এক পরম মানবিক দৃশ্য। ভিড়ের মধ্যে তাঁকে নামানো হলো তাঁর মায়ের পায়ের কাছে। মুহূর্তে সাবের মাটিতে বসে মায়ের পায়ে চুমু খেতে শুরু করলেন। এই দৃশ্যে ভিড়ের চোখও অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল—দীর্ঘ ২৪ বছরের নীরবতা যেন এই চুম্বন দিয়েই ভাঙল!
সাবেরের এক আত্মীয়, যিনি দুই বছর ধরে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি, তিনি তাঁর শীর্ণ শরীর দেখে ফিসফিস করে বললেন, ‘ওকে তো জিন্দা লাশের মতো দেখাচ্ছে! কিন্তু আমরা ওকে আবার বাঁচিয়ে তুলব।’ তিনি সাবেরের মুখে ফোন গুঁজে দিলেন, যাতে সাবের তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক ভাগনির সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলতে পারেন। কারাগারে অপুষ্টিতে ভোগা সাবেরকে নিয়ে তাঁদের চিন্তা শুরু হলো তখনই। রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে সাবেরকে সাবধানে খাওয়াতে হবে, কারণ তাঁর পেট এত খাবার নিতে অভ্যস্ত নয়।
কারাগারের ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে সাবের কাঁপা কাঁপা গলায় শুধু বললেন—‘ভয়ংকর!’ প্রতিশোধের ভয়ে এর বেশি কিছু বলতে সাহস পেলেন না তিনি। দুই দশক ধরে ইসরায়েলি কারাগারে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হওয়া হাজারো ফিলিস্তিনির কষ্ট যেন এই একটি শব্দে লুকিয়ে ছিল। অন্য বন্দীরাও তাঁদের দুরবস্থার কথা জানালেন, কেউ কেউ বললেন, গত দুই বছর ছিল তাঁদের জীবনের ‘সবচেয়ে খারাপ সময়’।
সাবেরের মতো কেউ কেউ যখন আনন্দে মাতোয়ারা, তখন কয়েক মিটার দূরেই অপেক্ষা করছিলেন উম্ম আবেদ। তিনি অপেক্ষা করছিলেন তাঁর ভাই কামাল ইমরানের জন্য। কামালও মুক্তিপ্রার্থীদের তালিকায় ছিলেন। ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী তাঁদের বাড়িতে এসে কঠোরভাবে নিষেধ করে গিয়েছিল কোনো ধরনের আনন্দ-উৎসব না করতে। এই নিষেধাজ্ঞা জানান দিচ্ছিল যে কামাল অবশ্যই মুক্তি পাচ্ছেন।
দুই দিন ধরে অপেক্ষার পর বাসগুলো যখন একে একে খালি হতে শুরু করল, উম্ম আবেদের বুক ধড়ফড় করছিল। প্রতিটি মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি কেবল কামালকে খুঁজছিলেন। হঠাৎই খবর আসে, কামালকে গাজায় নির্বাসন দেওয়া হতে পারে—এই খবর শুনেই তিনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। যদি কামালকে গাজায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে হয়তো আর কোনো দিনই তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না।
শেষ বন্দীটিও যখন বাস থেকে নেমে গেলেন এবং কামাল ইমরানের দেখা মিলল না, উম্ম আবেদ দুই হাতে নিজের গাল চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন, ‘আমরা দুই দিন ধরে এখানে ওর জন্য অপেক্ষা করছি। মুক্তি না পেয়ে নির্বাসনের খবর শুনে আমরা স্তম্ভিত।’
তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কামালের আত্মীয় রায়েদ ইমরান হতাশায় মুষড়ে পড়লেন। তিনি উম্ম আবেদকে টেনে গাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিলেন, যেখানে কামালকে গ্রহণ করার জন্য মিষ্টি ও ফুল রাখা ছিল। রায়েদ বললেন, ‘যদি নির্বাসনই দিতে হতো, তবে প্রথম থেকে আমাদের বলে দিলেই হতো! আমরা জানি না সে এখন কোথায়—মিসরে না গাজায়? আমরা ধ্বংস হয়ে গেলাম!’ কান্নায় ভেঙে পড়া আরেকজন নারী চিৎকার করে বলছিলেন, ‘কেন তারা ওকে নির্বাসন দিচ্ছে?’
এভাবে, যুদ্ধবিরতির পর বন্দী মুক্তির দিনটি রামাল্লার জন্য একই সঙ্গে হয়ে রইল মুক্তি ও হতাশার দিন—একদিকে যেমন ফিলিস্তিনিদের মুক্তির অদম্য আকাঙ্ক্ষার জয় হলো, তেমনি অন্যদিকে অবিচার ও অনিশ্চয়তার বেদনা আরও গভীর হলো। দিনটি প্রমাণ করল, অধিকৃত অঞ্চলের মানুষের জীবনে ব্যক্তিগত আনন্দ ও রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি একসূত্রে গাঁথা।