জারিফা জান (৬৫), উত্তর কাশ্মীরের বান্দিপোরা জেলায় বসবাসকারী একজন সুফি কবি। তিনি কখনো স্কুলে যাননি। স্থানীয় কাশ্মীরি ভাষায় সুন্দর কথা বলতে পারেন, কিন্তু এই ভাষা পড়তে বা লিখতে তিনি অপারগ। সোজা কথায় নিরক্ষর।
অথচ অনর্গল লিখে যাচ্ছেন কবিতা। তাঁর এই লেখা তিনি ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ পড়তে পারেন না। নিরক্ষর জারিফা জান নিজের কবিতা সংরক্ষণের একটা উপায় নিজেই উদ্ভাবন করেছেন। তিনি কবিতা লেখেন নিজস্ব কোডেড ভাষায়।
জারিফার কোড ভাষার হরফ বৃত্তের মতো। তাঁর কবিতার খাতার মধ্যে সারি সারি বৃত্ত। আরবি বা কাশ্মীরি লিপির মতো তিনিও লেখেন ডান থেকে বামে।
সুফিবাদ হলো ইসলামের একটি আধ্যাত্মিক অতীন্দ্রিয় রূপ। আধ্যাত্মিকতা অনুশীলনের একটি অপ্রচলিত চিন্তা পদ্ধতি বলা যেতে পারে। এ ঘরানায় ধর্মীয় জীবনের গুপ্ত/নিগূঢ় বিষয়গুলোর ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। সুফিরা আল্লাহর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লাভের জন্য আজীবন সাধনা করেন।
জারিফার কবিতায় দীক্ষা শুরু হয়েছিল বিয়ের কয়েক বছর পর। যখন তাঁর বয়স ত্রিশের কোটার শেষের দিকে। একদিন কাছাকাছি একটি স্রোতস্বিনী থেকে পানি আনতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হলো যেন মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল। এতদিনের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নিমেষে যেন হাওয়া হয়ে গেল! এক গভীর খাদের মধ্যে পড়ে গেছেন বলে বোধ হতে শুরু করল। জ্ঞান ফিরে দেখেন পানির কলসটি নেই। নিজেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ বলে বোধ হতে শুরু করল!
এটা জারিফা জানের দাবি। তিনি বলেন, ‘যখন আমার জ্ঞান ফিরল, তখন মুখ থেকে একটি গজল বেরিয়েছিল।’
উল্লেখ্য, ‘গজল’ হলো কবিতা বা গীতি কবিতা। আরবি কবিতা থেকে এই ধরন উদ্ভূত। গজল সাধারণত প্রেম, আকাঙ্ক্ষা ও বিচ্ছেদ বা বেদনার মতো বিষয়বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
জারিফা জান বলেন, ‘তখন পর্যন্ত আমার কবিতা সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু এরপর থেকে আমি শত শত কবিতা ও গজল লিখেছি।’
স্বরচিত কবিতা থেকে কয়েকটি ছত্র পড়ে শোনান জারিফা জান, যেটির বাংলা তরজমা করলে মোটামুটি এ রকম দাঁড়ায়:
‘আমি আমার যৌবনকে জলাঞ্জলি দিইনি,
একটা আগুন, আমাকে বাঁচিয়ে রাখে,
আমার যৌবন ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে অমূল্য।’
জারিফা যখন বুঝতে পারেন যে তিনি কবিই হবেন, তখন তাঁর সন্তানেরা সবে স্কুলে যেতে শুরু করেছে। তারা ইংরেজি ও উর্দুতে পড়তে এবং লিখতে শিখছিল। কিন্তু জারিফার হৃদয় বুঁদ হয়ে আছে কাশ্মীরি কবিতায়। এটি এমন এক ভাষা, যেটি অবহেলায় ক্ষয়ে যাচ্ছে, এমনকি খোদ কাশ্মীরেও এই ভাষা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে।
এই কবিতাগুলো সম্পর্কে প্রথমে তাঁর স্বামী এবং এরপর সন্তানদের জানান জারিফা। তবে এই সাহস সঞ্চয় করতে তাঁর বেশ কয়েক বছর লেগেছিল। কিন্তু জারিফাকে অবাক করে দিয়ে তাঁরা সবাই তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু দেখে বিস্মিত হয়েছিল। ততদিনে জারিফা তাঁর অনেক সৃষ্টিই হারিয়ে ফেলেছেন। কারণ কয়টা কবিতাই বা মুখস্থ করে রাখা যায়!
সন্তানদের উৎসাহেই এরপর শুরু হয় সংরক্ষণের কাজ। প্রথমে বড় ছেলে শাফাত টেপে রেকর্ড করার চেষ্টা করেন। এরপর বড় মেয়ে কুলসুম তাঁর সামান্য কাশ্মীরি ভাষাজ্ঞান দিয়ে লিখে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু এই দুই পদ্ধতির কোনোটিতেই সন্তুষ্ট ছিলেন না জারিফা।
তা ছাড়া কবিতা রেকর্ড করে বা লিখে রাখার জন্য তো সব সময় সন্তানদের কাছে পাওয়া যায় না। যখন কোনো কবিতার জন্য চিন্তা করেন বা মাথায় একটি কবিতা/কবিতাংশ হাজির হয়, তখন তো সব সময় সন্তানদের পাশে পান না। বা থাকলেও হয়তো সঙ্গে টেপরেকর্ডার বা এক টুকরা কাগজ ও কলম থাকে না।
এত সব যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে নিজেই একটি কৌশল উদ্ভাবন করেন জারিফা। বিভিন্ন পরিচিত প্রতীক দিয়ে, অনেকটা শর্টহ্যান্ডের মতো করে কবিতা লিখে রাখতে শুরু করেন। যেমন: কবিতায় আপেল শব্দ থাকলে হয়তো আপেল এঁকে রাখেন, আবার হৃদয় থাকলে একটি হার্ট এঁকে রাখেন। পরে মেয়ে কুলসুম যখন সময় পান, তখন জারিফা সেসব ডিকোড করে বলতেন আর মেয়ে সেগুলো প্রচলিত অক্ষরে লিখে রাখতেন।
জারিফা বলেন, ‘কিন্তু আমি তো নিরক্ষর, আগে কখনো কলম ধরিনি। ফলে আমি যা-ই আঁকি, শেষ পর্যন্ত তা বিভিন্ন আকৃতি ও আকারের বৃত্তই হয়ে যায়। যেমন, আমি একটা কলা আঁকলেও সেটা বৃত্তাকার হয়ে যায়!’
তবু এই অদ্ভুত, বৃত্তাকার আকৃতিগুলো জারিফার জন্য খুব কার্যকর ছিল। এগুলো দিয়ে তিনি প্রায় নির্ভুলভাবেই তাঁর কবিতার লাইনগুলো স্মরণে রাখতে পারতেন। এই সংকেতগুলোর ওপর ভিত্তি করেই মেয়েকে তিনি ডিকোড করে শোনাতেন। বছর তিনেক আগে কুলসুমের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এভাবে জারিফার কবিতার সংরক্ষণকাজ চলেছে। মেয়ের মৃত্যুর পর শোকে মুহ্যমান জারিফা প্রায় সবকিছু ছেড়ে দেন।
এই বৃত্তের মধ্যেই জারিফার প্রায় ৩০০ কবিতা সংরক্ষিত রয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে সেগুলো বই আকারে প্রকাশের চেষ্টা চলছে।
অনেকে বলছেন, বইটি প্রকাশ পেলে জারিফা বিশ্বের প্রথম কবি হতে পারেন, যিনি তাঁর সৃষ্টি সংরক্ষণের জন্য নিজস্ব বর্ণমালা তৈরি করেছেন।
যদিও অনেকে জারিফাকে সন্দেহ করেন। তাঁরা বলেন, নিজস্ব বর্ণমালায় লেখা কবিতা শুধু তিনিই পড়তে পারেন, এটা একটা ভণিতা ছাড়া কিছু নয়। তিনি সত্যিই এভাবে সংরক্ষণ করেন, নাকি বানিয়ে বানিয়ে বলেন কে জানে!
তবে কাশ্মীরের বয়োবৃদ্ধ ও শ্রদ্ধেয় সুফি কবি আবদুল করিম পরওয়ানা জারিফাকে বিশ্বাস করেন। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো কবিই তাঁর লেখা সবকিছু মনে রাখতে পারে না। আমি আমার জীবদ্দশায় এমন কাউকে দেখিনি বা শুনিনি যে তাঁর পুরো কবিতা সংকলন মনে রাখতে পারেন। জারিফা একজন আধ্যাত্মিক কবি। আর আধ্যাত্মিকতায় সবকিছুই সম্ভব!’