হোম > স্বাস্থ্য

কমিউনিটি ক্লিনিক

৮ মাস ধরে বেতন নেই ১৪ হাজার কর্মীর

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা

গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের ‘কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা’ (সিএইচসিপি) বেতন পাচ্ছেন না আট মাস ধরে। পরিবার নিয়ে তাঁরা দুঃসহ আর্থিক অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, স্বাস্থ্য খাতের পাঁচ বছর মেয়াদি অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) চালু না থাকায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে কমিউনিটি ক্লিনিকে ওষুধের অভাবও দেখা দিয়েছে কোথাও কোথাও।

‘স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি (এইচপিএনএসপি)’ নামে এই ওপি গত বছরের জুনে শেষ হলেও নতুন পর্ব শুরু হয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে রাজস্ব খাত থেকে সিএইচসিপিদের বেতন দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। ১৪ হাজারের বেশি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এখন অধীর আগ্রহে তারই পথ চেয়ে আছেন।

দেশের স্বাস্থ্য খাতের সিংহভাগ অবকাঠামো, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, হাসপাতালের সেবা ব্যবস্থাপনা এবং টিকা ও পুষ্টি কার্যক্রমসহ ৩০টির বেশি কর্মসূচি পরিচালিত হয় পাঁচ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা বা অপারেশনাল প্ল্যানের (ওপি) মাধ্যমে। গত বছরের জুনে শেষ হয় ‘চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি’। ওই বছরের জুলাই মাসেই পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য ১ লাখ ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকার পঞ্চম এইচপিএনএসপি শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে সময় তা অনুমোদন করেনি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সিএইচসিপিদের সংগঠন বাংলাদেশ কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছে, ওপি চালু না থাকায় ১৪ হাজারের কিছু বেশি সিএইচসিপি গত জুনের পর আর বেতন পাননি।

তৃণমূল পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান কমিউনিটি ক্লিনিক। ১৯৯৮ সালে গ্রামাঞ্চলের প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের পরিকল্পনা করে সরকার। দেশজুড়ে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মিত হয়েছে। এখানে গর্ভকালীন ও প্রসূতিসেবা, শিশুদের যাবতীয় রোগের চিকিৎসা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই), পুষ্টিবিষয়ক শিক্ষাদান ও পরামর্শ এবং পুষ্টিকর অতিরিক্ত খাদ্য সরবরাহসহ বেশ কিছু সেবা দেওয়া হয়।

দেশজুড়ে কষ্টের দিনলিপি

আট মাস ধরে বেতন না পাওয়ায় পরিবারের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন সিএইচসিপিরা। অনেকে জড়িয়ে পড়েছেন ঋণে।

জয়পুরহাট জেলার ১১৩টি কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপিরা গত বছরের জুলাই মাস থেকে বেতন না পাওয়ায় কষ্টে দিন যাপন করছেন। সদর উপজেলার চকবরকত ইউনিয়নের আরজি-জগদীশপুরের সিএইচসিপি আসাদুজ্জামান বলেন, ‘কম বেতনের চাকরিতে এমনিতেই দিন চলে টানাটানি করে। তার ওপরে সোনালী ব্যাংক থেকে ৫ লাখ টাকা স্যালারি ঋণ নেওয়া আছে। কিছু ধার-দেনাও হয়েছে। খুব কষ্টে আছি।’

ক্ষেতলাল উপজেলার বড়তারা ইউনিয়নের কেশুরতা ক্লিনিকের মনিরা বেগম বলেন, ‘বেতন নাই। কিস্তি দিতে পারছি না। প্রতিদিন অন্যের কথা শুনতে হয়।’

বাগেরহাটে ৭ মাস ধরে বেতন পান না ২১১ ক্লিনিকের সিএইচসিপিরা। চরম অর্থকষ্টে ভুগছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া এসব কর্মী। কোথাও কোথাও নিয়মিত ওষুধের সরবরাহও বন্ধ রয়েছে।

কচুয়া উপজেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামের মো. বাশার শেখ বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে ক্লিনিকে গেলে ঠিকঠাক সেবা পাই না। ওষুধ চাইলে বলে নাই। আবার শুনছি সিএইচসিপিরা ঠিকমতো বেতন পান না। তাই কাজে কম আসছেন তাঁরা।’

মেহেরপুরের গাংনীর হোগলবাড়িয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি মো. সাজেদুর রহমান বলেন, ‘কী কষ্টে যে আছি, তা বলে বোঝানো সম্ভব না। আমি অসুস্থ, স্ত্রী অসুস্থ...ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া। সব মিলিয়ে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে বসবাস করছি।’

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আখড়াখোলা ক্লিনিকের শামীম হোসেন বলেন, ‘ওপি না থাকার কারণে বেতন হচ্ছে না। আমরা পরিবার নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছি।’

সিএইচসিপিদের জাতীয় সংগঠনের সভাপতি ও ঢাকার কেরানীগঞ্জের শাক্তা ইউনিয়নের অগ্রখোলা কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মী জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শুনেছি, সংশোধিত বাজেট অনুমোদনের পর রাজস্ব খাত থেকে আমাদের বেতন হবে। আর জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বেতন দেওয়া হবে ওপি থেকে। এসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঠিক কবে নাগাদ বেতন হাতে পাব, বুঝতে পারছি না।’

এ ছাড়া জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার ২১টি ক্লিনিক; কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ৩৫টি ক্লিনিক; দিনাজপুরের বিরামপুর, ফুলবাড়ী ও খানসামা উপজেলার ৭১টি ক্লিনিক; ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার ১৬টি ক্লিনিক, চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের ২০টি ক্লিনিক এবং মেহেরপুরের গাংনীর ৩৫টি ক্লিনিকের কর্মীদের বেতন না পাওয়ার কথা সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানিয়েছেন আজকের পত্রিকার প্রতিনিধিরা।

ওষুধের ঘাটতির আশঙ্কা

কমিউনিটি ক্লিনিকের ওষুধের ব্যয় আসে পাঁচ বছর মেয়াদি ওপি থেকে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ক্লিনিকে সর্বশেষ ওষুধ সরবরাহ করা হয় গত ২ অক্টোবর। সাধারণত এক দফার সরবরাহে চার থেকে পাঁচ মাস চলে। সংকটের আশঙ্কায় কেন্দ্র থেকে ওষুধ বিতরণে সতর্ক হতে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক সিএইচসিপি। বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ঠান্ডা-জ্বর ও কৃমির ওষুধ এবং আয়রন, ফলিক অ্যাসিডসহ বিভিন্ন ধরনের ২২টি ওষুধ বিনা মূল্যে দেওয়া হয়।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ারের (সিবিএইচসি) লাইন ডিরেক্টর ডা. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ওষুধের সংকট দেখা দিতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘ওষুধ ওপি থেকে নাকি রাজস্ব খাত থেকে কেনা হবে, তা এখন বিবেচনাধীন। কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্টের কাছে অর্থ বিভাগ ওষুধের বাজেট চেয়েছে। সংকটের শঙ্কায় আমরা ক্লিনিকগুলোকে যৌক্তিকভাবে ওষুধ খরচ করতে বলেছি।’

ওপি ছেড়ে সমাধানের পথে

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চলমান ওপি প্রক্রিয়া থেকে বের হওয়ার কথা ভাবছে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। ১৩ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে বর্তমান সেক্টর কর্মসূচি পদ্ধতির ওপি থেকে বের হওয়ার কৌশল নির্ধারণের জন্য সভা হয়। এতে পুরো কর্মসূচিকেই রাজস্ব খাতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যেই (সম্ভাব্য তারিখ) সংশোধিত বাজেট অনুমোদনের পর রাজস্ব খাত থেকে সিএইচসিপিদের বেতন দিতে আরও তিন মাসের মতো সময় লাগবে। পঞ্চবার্ষিক এই কর্মসূচির বিকল্প ভাবার জন্য পরিকল্পনা কমিশন থেকেও তাগিদ দেওয়া হয়েছিল।

সিবিএইচসির লাইন ডিরেক্টর ডা. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেছেন, ওপিতে যেসব কর্মসূচি বা দপ্তর কর্তৃপক্ষ কাজ করে, তাদের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে ওপি থেকে বের হওয়া এবং এর কার্যক্রম ভবিষ্যতে কীভাবে পরিচালনা করা যায়, তার রোডম্যাপ (পথনকশা) থাকতে হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের অভিমত

বর্তমান ওপি পদ্ধতি থেকে বের হওয়ার জন্য কমপক্ষে দুই বছর আগে পরিকল্পনা থাকার প্রয়োজন ছিল বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট (ইলেক্ট) অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা খাতের সবচেয়ে বড় কর্মসূচি এই এইচপিএনএসপি নামের ওপি। এটা প্রায় ৩০ বছর ধরে চলছে। জনস্বাস্থ্যের বড় কাজগুলো এর মাধ্যমেই হয়। পরিবর্তন করতে চাইলে ওপি চলমান অবস্থায় দু-তিন বছর আগেই এ থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার ছিল।’

প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আজকের পত্রিকার বাগেরহাট, জয়পুরহাট ও কোটচাঁদপুর (ঝিনাইদহ), গাংনী (মেহেরপুর), জীবননগর (চুয়াডাঙ্গা), ভূরুঙ্গামারী (কুড়িগ্রাম), আক্কেলপুর (জয়পুরহাট) এবং দিনাজপুরের বিরামপুর, ফুলবাড়ী ও খানসামা প্রতিনিধি।

আরও খবর পড়ুন:

কিডনি রোগীর বন্ধু কামরুল

কবিরাজিসহ প্রথাগত চিকিৎসার কার্যকারিতা খতিয়ে দেখছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

শীতে খিচুড়ি কেন খাবেন

এই শীতে কেন খাবেন তেজপাতা ও লবঙ্গ চা

ঘুমের ঘোরে খাওয়া রহস্যময় ও জটিল এক স্বাস্থ্য সমস্যা

যে ছয় কারণে দীর্ঘস্থায়ী শুকনো কাশি হয়

ঠান্ডার সময় ব্যায়াম শুরু করার আগে

ভারতে চিকিৎসকদের জন্য হাতে প্রেসক্রিপশন লেখার নতুন নিয়ম

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি: অর্থায়ন বন্ধে যক্ষ্মা বিস্তারের শঙ্কা

এমবিবিএস ও বিডিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাসের হার ৬৬.৫৭ শতাংশ