গতকাল ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই যাত্রা শুরু করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়টির সবুজ ক্যাম্পাস। ফলে ইতিহাসচর্চায় এক দারুণ অর্জন আছে এর।
দেশের প্রায় প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। ইতিহাসের এসব ঘটনা স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন ভাস্কর্য, স্থাপনা ও জাদুঘর। এসব অবকাঠামো নির্মাণ করে কাজ সারা হয়নি; বরং এগুলোকে ইতিহাসচর্চার অনুষঙ্গ করে নেওয়া হয়েছে। নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস-সচেতন করে তুলতে কাজে লাগানো হচ্ছে এসব ভাস্কর্য, স্থাপনা ও জাদুঘরকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই দেখা যাবে, মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামের তালিকার ফলক। দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক জাদুঘর ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’ তৈরি হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। মূলত স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ হওয়া শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে গড়ে উঠেছে এটি। যুদ্ধকালীন বিভিন্ন উপকরণ সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৭৬ সালের ৬ মার্চ এই সংগ্রহশালা উদ্বোধন করা হয়। এর সামনে একটি উঁচু মঞ্চে রাখা আছে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত সবুজ রঙের বিধ্বস্ত একটি গাড়ি।
শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় আছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোকচিত্র, শহীদদের প্রতিকৃতি, কোলাজ, ভাস্কর্য ও বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি। ৬ হাজার ৬০০ বর্গফুট আয়তনের সংগ্রহশালাটিতে আছে ৩টি গ্যালারি। আলাদা গ্যালারিতে সাজানো রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সরঞ্জাম ও বিভিন্ন আলোকচিত্র। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত শহীদের ব্যবহৃত পোশাক ও অন্যান্য দুর্লভ জিনিসপত্র এবং একটি পাঠাগার রয়েছে এখানে। পাঠাগারটি গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত।
প্রধান ফটক থেকে সামনে তাকালেই দেখা যায় উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. মো. শামসুজ্জোহার সমাধি চত্বর। ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যেকোনো আন্দোলনের প্রধান জায়গা এই জোহা চত্বর। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে রয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ১৯৭২ সালের ৯ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিচর্চার প্রধান কেন্দ্র এই শহীদ মিনার চত্বর।
পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার জীবন্ত সাক্ষ্য বহন করে চলেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমি। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ আশপাশের এলাকার লোকজনকে হত্যা করে জোহা হলের পেছনে মাটিচাপা দিয়েছিল। ১৯৭২ সালের ২৩ এপ্রিল আবিষ্কৃত হয় এখানকার গণকবরগুলো। ধারণা করা হয়, প্রায় ৪ হাজার মানুষকে হত্যা করে পুঁতে রাখা হয় এই গণকবরগুলোতে। পরবর্তী সময়ে এখানে নির্মিত হয় ‘বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ’।
৭০ বছর ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাস যেন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইতিহাসচর্চার এই অভিনবত্ব পুরো ক্যাম্পাসকে অনন্য করে তুলেছে।
শহীদ শামসুজ্জোহা হলের বাম দিকে রয়েছে 'স্ফুলিঙ্গ' নামে একটি ভাস্কর্য। এটি শহীদ শামসুজ্জোহার স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে। চারুকলা বিভাগের প্রভাষক কনক কুমার পাঠক ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন।