গাইবান্ধা সদর উপজেলার মানুষের মুখে মুখে একটি নাম—লুৎফর রহমান। স্থানীয়ভাবে তিনি পরিচিত ‘এক টাকার মাস্টার’ নামে। অর্ধশতাব্দী ধরে তিনি গাইবান্ধার প্রত্যন্ত গ্রামে ঘুরে ঘুরে দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের মধ্যে মাত্র এক টাকার বিনিময়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এই প্রবীণ শিক্ষকের বয়স এখন প্রায় ৮০ বছর।
সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের বাগুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. লুৎফর রহমান। ১৯৭২ সালে তিনি ফুলছড়ি উপজেলার গুণভরি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি (ম্যাট্রিক) পাস করেন। কিন্তু চরম দারিদ্র্যের কারণে তাঁর আর কলেজে পড়া হয়নি। পড়তে না পারার সেই কষ্টই তাঁকে প্রেরণা জোগায়। তিনি দেখেন, দরিদ্র পরিবারের শিশুরা টাকার অভাবে লেখাপড়া করতে পারছে না, প্রাইভেট বা কোচিং নেওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। এসব পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই দিনমজুর, যাদের পেটের ভাত জোগাড় করা দুঃসাধ্য।
এমন শিশুদের ঝরে পড়া ঠেকাতে ১৯৮৪ সাল থেকে তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ানোর উদ্যোগ নেন। শুরুতে বিনা পয়সায় পড়ালেও পরে ১০-১২ জনকে একত্র করে তিনি প্রতিদিন মাত্র চার আনা (বর্তমানে এক টাকা) করে ভাতা নেওয়া শুরু করেন। এই নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে তিনি বাগুড়িয়া, মদনেরপাড়া, ঢুলিপাড়া, কঞ্জিপাড়া, পুলবন্দি, চন্দিয়াসহ আশপাশের অন্তত সাত-আটটি গ্রামে শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেন। হেঁটে বা সাইকেলে চেপে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছুটে বেড়ানোই তাঁর নিত্যদিনের কাজ।
একসময় সচ্ছল থাকলেও ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যা ও ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে লুৎফর রহমানের বাড়িঘর, জমি সব বিলীন হয়ে যায়। নিঃস্ব হয়ে তিনি গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁধের পাশে ছোট্ট একটি টিনের ঘরে স্ত্রী লতিফুন বেগম, দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নেন। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামের পথচলা।
তাঁর বড় ছেলে লাভলু অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালান এবং ছোট ছেলে মশিউর দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স সমমান) সম্পন্ন করেছেন। অভাবের তাড়না থাকলেও শিক্ষার প্রতি লুৎফর রহমানের নিবেদন আজও অটুট।
বর্তমানে তিনি ৩০-৪০ জন শিক্ষার্থীকে পড়ান। কোথাও রাস্তার ধারে, কোথাও গাছতলায় কিংবা বাঁধের ওপর বসেই চলে তাঁর ক্লাস।
তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী লাবণী আক্তার বলে, ‘স্যার খুব আদর করে পড়ান। আমরা স্কুলে না গেলে নিজেই বাড়ি গিয়ে ডেকে আনেন। তাঁর কাছে পড়তে খুব ভালো লাগে।’ আরেক শিক্ষার্থী তানিয়া আক্তার বলে, ‘আমরা প্রতিদিন স্যারকে এক টাকা করে দিই। স্যার আমাদের এত সুন্দরভাবে বুঝিয়ে পড়ান, না বুঝলে বারবার ব্যাখ্যা দেন।’
শিক্ষার্থীদের অভিভাবক আমেনা বেগম বলেন, ‘এখন এক শিশুকে প্রাইভেটে পড়াতে গেলে হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। সেখানে লুৎফর স্যার নামমাত্র টাকায় শিক্ষা দিচ্ছেন। তাঁর অনেক ছাত্র এখন বিসিএস কর্মকর্তা ও বিভিন্ন ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। তিনি আমাদের এলাকার গর্ব।’
নিজের জীবনের গল্প তুলে ধরে লুৎফর রহমান বলেন, ‘ম্যাট্রিকের পর অর্থাভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারিনি। সেই না পাওয়ার কষ্ট আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই আমি চাই না আমার এলাকার কোনো শিশু পড়াশোনা থেকে পিছিয়ে থাকুক।’
লুৎফর রহমান আরও বলেন, ‘প্রথমে বিনা পয়সায় পড়াতাম। পরে নামমাত্র এক টাকা নিতে শুরু করি। কেউ না দিলেও কিছু বলি না। আমার অনেক ছাত্র এখন ডাক্তার, প্রভাষক, অধ্যক্ষ—ওদের সাফল্যই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।’
শারীরিক কষ্ট ও আর্থিক সংকট থাকা সত্ত্বেও তিনি শিশুদের পড়ানো থামাননি। তিনি বলেন, ‘শিশুদের পড়াতে গেলে অভাবের কথা ভুলে যাই। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমার এই কাজ অব্যাহত রাখতে চাই।’
গিদারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ জানান, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সাধ্য অনুযায়ী লুৎফর মাস্টারকে সুবিধা দেওয়া হয়। তবে মানবতার এই সেবককে সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে আরও সহায়তা করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
গাইবান্ধা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদ আল হাসান বলেন, ‘লুৎফর মাস্টারকে ইতিমধ্যে কয়েকবার সহযোগিতা করা হয়েছে। তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী তাঁকে আরও সহযোগিতা করার চেষ্টা করা হবে।’
৫০ বছরের এই শিক্ষাদান যেন টাকার বিনিময়ে নয়, এটি মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। লুৎফর রহমানের ত্যাগ, মমতা ও নিবেদন উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ শিক্ষায় আজও এক প্রেরণার বাতিঘর হয়ে জ্বলছে।