হোম > সারা দেশ > রাজশাহী

রাজা কংসনারায়ণের দুর্গাপূজা, যার শুরু সাড়ে ৫০০ বছর আগে

রিমন রহমান, রাজশাহী

মহাষষ্ঠীর সকালে ঢাকি সুকেশ স্যানাল ঢাকে কাঠির বাড়ি দিয়েই যাচ্ছেন। পূজার জোগালি কানাই হালদার, আর পুরোহিত গোপাল চক্রবর্তী এটা-ওটা গোছাতে ভীষণ ব্যস্ত। কথা বলতে চাইলে করজোড় করে পুরোহিত বললেন, ‘এখন পারব না যে দাদা। ষষ্ঠী কল্পরাম্ভের বেলা বয়ে যাচ্ছে। এখনই পুজো করতে হবে।’ 

যে মণ্ডপ নিয়ে কথা, সেটির নাম শ্রীশ্রী গোবিন্দ ও দুর্গামাতা মন্দির। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার তাহেরপুরে এই মন্দির। এটি এখন বাগমারার একটি পৌর এলাকা। রাজশাহী জেলা সদর থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরের এই তাহেরপুরের আদিনাম ছিল ‘তাহিরপুর’। আজ থেকে ৫৪০ বছর আগে এখান থেকেই সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসবের শুরু বলে ধারণা করা হয়। সে আমলে রাজা কংস নারায়ণ রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা খরচ করে রাজবাড়িতে ওই আয়োজন করেছিলেন। এখনকার আমলে ওই টাকার পরিমাণ ৩০০ কোটিরও বেশি। একবার দুর্গোৎসবের আয়োজনে কোনো মণ্ডপে এত টাকা খরচ আর হয়েছে বলে জানা যায়নি। সম্রাট আকবরের আমলে বাংলার ‘বারো ভূঁইয়া’-এর এক ভূঁইয়া রাজা কংসনারায়ণ রায় ব্যয় করেছিলেন এ অর্থ। 

এর আগে মহাশক্তির আরাধনা করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু এত টাকা ব্যয় করে কোনো রাজবাড়িতে দুর্গাপূজার প্রথম আয়োজনটা সম্ভবত করেছিলেন রাজা কংসনারায়ণ। তাঁর সৌজন্যে মানুষ দেখেছিল অকালবোধনে আধুনিক দুর্গাপূজা। 

তাহিরপুরের রাজবংশ ছিল বাংলার প্রাচীন রাজবংশগুলোর অন্যতম। এই রাজবংশের আদিপুরুষ মৌন ভট্ট। বংশের শ্রেষ্ঠ সামন্ত ছিলেন কংসনারায়ণ রায়। মোগল-পূর্ব সময়ে চট্টগ্রামের মগ দমন, ফৌজদারের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। রাজা টোডরমলের সঙ্গে ভূমি বন্দোবস্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালান করেন কংসনারায়ণ। তিনি ভেবেছিলেন, সম্রাট তাঁকে বাংলার সুবেদার করবেন। কিন্তু সম্রাট তাঁকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করে বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত করেন। এরপর তিনি মনঃক্ষুণ্ন হয়ে বয়স বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে সে দায়িত্ব ফিরিয়ে দেন সবিনয়ে। 

কংসনারায়ণ এমন কিছু করতে চাইলেন, যার জন্য হিন্দুসমাজ তাঁকে আজীবন মনে রাখবে। রাজা পণ্ডিতদের ডাকলেন রাজসভায়। জানালেন, তিনি আয়োজন করতে চান অশ্বমেধ যজ্ঞ। পণ্ডিতেরা রাজার এ ইচ্ছে নাকচ করে দিলেন প্রথমেই। তাঁরা বললেন, কলিযুগে অশ্বমেধ যজ্ঞের বিধান শাস্ত্রে নেই। এ কথা শুনে রাজার তো মন খারাপ। 

ঠিক তখনই পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী দিলেন দুর্গাপূজার পরামর্শ। কারণ, দেবী দুর্গতিনাশিনীর পূজা নিজেই এক মহাযজ্ঞ। এতে সমস্ত মহাযজ্ঞের সমান ফল পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, যেকোনো যুগে যে কেউ করতে পারে এই পূজা। পরামর্শ পছন্দ হলো রাজার। তিনি আদেশ করলেন, এই শরতেই যেন আয়োজন হয় এ উৎসবের। কথামতো কাজ। সব প্রস্তুতি শেষ। 

মহাসমারোহে হলো দুর্গোৎসব। ষোলো শতকের সে উৎসবে ব্যয় হয় প্রায় সাড়ে ৮ লাখ, মতান্তরে ৯ লাখ টাকা। বিরাট ওই উৎসব হয়েছিল রামরামা গ্রামের দুর্গামন্দিরে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে দেখে গেল এই উৎসব। রাজা কংসনারায়ণের প্রপৌত্র (চতুর্থ পুরুষ) লক্ষ্মীনারায়ণের সময় সুবেদার শাহ সুজার সৈন্যদল বারণই নদের পূর্ব তীরে রামরামা গ্রামের রাজা কংসনারায়ণের প্রসাদটি ধ্বংস করে দেয়। 

লক্ষ্মীনারায়ণ পরবর্তী সময়ে সম্রাট আওরঙ্গজেবের অনুকম্পায় নদীর পশ্চিম তীরে লাভ করেন একটি পরগনা। তিনি সেখানে একটি রাজবাড়িও নির্মাণ করেন। ১৮৬২ সালে পরবর্তী রাজা বীরেশ্বর রায়ের স্ত্রী জয়সুন্দরী দেবী নির্মাণ করেন দুর্গামন্দির। এটি এখনো আছে আগের মতো। শুধু ভেতরে টাইলস লাগানো হয়েছে। আজ সোমবার সকাল ১০টার কিছু আগে এখানেই পুজোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন পুরোহিত। 

মন্দিরেই পাওয়া গেল কমিটির সাধারণ সম্পাদক চিরঞ্জীব রায়কে। তাঁর দাদা রসিক রায় ছিলেন শেষ রাজার ম্যানেজার। চিরঞ্জীব রায় জানালেন, তাহিরপুর (বর্তমানে তাহেরপুর) রাজবংশের শেষ রাজা ছিলেন শিব শেখরেশ্বর রায়। তাঁর বাবা শশী শেখরেশ্বর রায়ের সময় থেকেই রাজবংশের লোকেরা কলকাতায় তৈরি করেন তাঁদের নতুন ঠিকানা। 

এরপর তাঁরা শুধু বছরে একবার পূজার সময় আসতেন। ১৯২৭ সালে তাঁরা শেষবারের মতো তাহিরপুরে এসেছিলেন। একসময় তাঁরাও যাতায়াত বন্ধ করে দেন। পরে ১৯৬৭ সালে রাজবাড়িটি তাহিরপুর ডিগ্রি কলেজে পরিণত হয়। তবে ১৯৮৩ সালের দিকে এসে আবারও কলেজের পাশের ওই মন্দিরে পূজা-অর্চনা শুরু হয়। মন্দিরের ভেতরে ঢুকলে প্রথমেই হাতের ডানে পড়বে শিবমন্দির। তারপর গোবিন্দ মন্দির, এরপর দুর্গামন্দির। চিরঞ্জীবের ধারণা, দুর্গামন্দিরের চেয়েও পুরোনো শিবমন্দির ও গোবিন্দ মন্দির। এসবই এক ঐতিহ্যের স্মারক। 

চিরঞ্জীব রায় বলেন, ‘ইতিহাস কখনো মুছে যাওয়ার নয়। এখান থেকেই দুর্গাপূজা সর্বজনীন রূপ নিয়েছে। তাই এটিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। তার আগে মন্দিরের চারপাশে যে রাজবংশের সম্পত্তি বেহাত হয়ে গেছে, তা উদ্ধার করা দরকার। কারণ, এগুলো তো মন্দিরেরই অংশ। সেগুলো ছাড়া মন্দিরটির অঙ্গহানি হয়ে আছে।’ 

মন্দিরের ভেতর ঢুকে দেখা গেল, কয়েকজন তরুণী গাঁদা ফুলের মালা গাঁথতে ব্যস্ত। কয়েকজন নারী ব্যস্ত ধোয়া-মোছার কাজে। কানাই হালদার পূজার জোগালি হিসেবে এ মন্দিরে কাজ করছেন ২৪ বছর ধরে। তিনি বললেন, ‘এখনো দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন। গত বছর করোনার কারণে ভক্তদের মুখে আনন্দ দেখিনি। এবার আনন্দ হবে।’ 

মন্দিরটিতে এখন আর মাটির প্রতিমায় দুর্গাপূজা হয় না। প্রতিমা বিসর্জনও করা হয় না। ২০১৮ সালে স্থানীয় সাংসদ এনামুল হক প্রায় ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে অষ্টধাতুর প্রতিমা বানিয়ে দিয়েছেন। এই মন্দিরে এখন রাজা নেই। নেই রাজাদের বংশধরেরাও। কিন্তু এই মন্দিরের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের উৎপত্তির ইতিহাস। যে ইতিহাস আর কখনো পুরোনো হওয়ার নয়।

আরএমপির ১২ থানায় ওসিদের রদবদল

সিরাজগঞ্জে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত ৩০

রাজশাহীতে এনসিপির কমিটি নিয়ে বিশৃঙ্খলা, বৈষম্যবিরোধীর পাঁচজনকে শোকজ

শিক্ষকদের ঢুকতে না দিয়ে পরীক্ষা নিলেন অভিভাবকেরা

রাজশাহীতে ৩৮ দফা দাবিতে মানববন্ধন

সিরাজগঞ্জে ৪৩ কেজি গাঁজাসহ গ্রেপ্তার ৩

তিন দাবি না মানলে রাবির সমাবর্তন বর্জনের ঘোষণা

আপাতত চিনি আমদানি বন্ধ— নাটোরে উপদেষ্টা আদিলুর

এনসিপির জেলা ও নগর আহ্বায়ক দুই মেরুতে

রামেকে মানসিক রোগীদের জন্য পূর্ণাঙ্গ ওয়ার্ড চালু