হোম > সারা দেশ > রাজশাহী

এক বছর আগে আইডি হ্যাক, পুলিশ মামলা করতে বললেও করেননি যুগ্ম সচিব

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

স্থানীয় সরকারের রাজশাহী বিভাগের পরিচালক এনামুল হক আগেই জানতে পেরেছিলেন, চাকরি দেওয়ার জন্য তাঁর নাম করে টাকা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এক বছর হয়ে গেলেও তিনি এ নিয়ে কোনো মামলা করেননি। পুলিশ কয়েকবার ডেকেও তাঁকে দিয়ে মামলা করাতে পারেনি। নিজের ফেসবুক আইডি ‘বেহাত’ হয়ে গেলেও সরকারের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এ কর্মকর্তা পদক্ষেপ নেননি। 

তাঁর এ ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এই ফেসবুক আইডির মাধ্যমেই প্রতারণার অভিযোগে র‍্যাব নওগাঁর ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনকে (৩৮) আটক করে। এনামুল হক নিজেও অংশ নেন এই অভিযানে। পরে র‍্যাব হেফাজতে জেসমিনের মৃত্যু হয়। এনামুলের কথায় মামলা ছাড়াই র‍্যাব জেসমিনকে আটক করেছিল। আটকের পরদিন জেসমিন যখন হাসপাতালে মুমূর্ষু অবস্থায়, তখন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন এনামুল। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, নিজের ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়ে যাওয়ার পরে এনামুল হক নগরীর রাজপাড়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন গত বছরের মার্চে। এরপর পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে দেখে, ‘হ্যাক’ করার পর এনামুলের ফেসবুকের মোবাইল নম্বরটি বদলে ফেলা হয়েছে। যে মোবাইল নম্বরটি পরে দেওয়া হয়েছে, সেই সিমটি কেনা হয়েছে একটি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে। এক মাসের মধ্যেই এনামুল হককে এসব জানিয়ে থানায় মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি মামলা করতে রাজি হননি। অন্যদিকে ওই ফেসবুক থেকে প্রতারণা চলতেই থাকে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এনামুল হকের ফেসবুক আইডি থেকে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগীরা তাঁর বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন। প্রায় পাঁচ মাস আগে এ ব্যাপারে তদন্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তখন এনামুল হক পুলিশের কাছ থেকে একটি প্রত্যয়ন নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যে তাঁর ফেসবুক হ্যাক হয়েছে। কিন্তু তখনো এনামুল হক ফেসবুক হ্যাকের ঘটনায় থানায় মামলা করেননি। 

পরে গত অক্টোবরে চাকরির জন্য টাকা দেওয়া ঢাকার এক ভুক্তভোগী নারী এনামুলের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ মামলায় রোমানা ফেরদৌস নামের আরেক নারীকে আসামি করা হয়, যাঁর মাধ্যমে টাকা গ্রহণ করা হতো। ফেসবুক আইডি থেকে পরিচয় দেওয়া হতো, রোমানা জেসমিন যুগ্ম সচিব এনামুল হকের স্ত্রী। ফেসবুক আইডির মাধ্যমে টাকা নেওয়ার কারণে মামলার আসামি হলেও হ্যাকের ঘটনায় তখনো মামলা করেননি এনামুল হক। 

কিন্তু ২২ মার্চ ১৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে জেসমিনকে আটকের পরদিন এনামুল হক রাজপাড়া থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে তিনি বলেছেন, অফিসের কাজে নওগাঁয় যাওয়ার পথে র‍্যাবের টহল দলের সঙ্গে তাঁর হঠাৎ দেখা হয়েছিল। এনামুল হক রাজ মেট্রো-ঘ ১১-০১১৮ নম্বরের একটি সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন। নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তার ট্রাভেল হিস্ট্রি লগবুকে উল্লেখ করতে হবে। কিন্তু এনামুল হক তা করেননি। তাঁর সরকারি গাড়ির চালক ইসরাইল জানিয়েছেন, ওই দিন সরকারি কাজে গাড়িসহ এনামুল হককে নিয়ে তিনি নওগাঁয় গিয়েছিলেন কি না, তা মনে নেই। গাড়ির লগবুকে তা লেখা নেই বলেও তিনি জানান। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুগ্ম সচিব এনামুল হক বলেন, ‘গাড়ির লগবুক প্রতিদিন লেখা হয় না। মাস শেষে একবারই ট্রাভেল হিস্ট্রি লেখা হয় লগবুকে।’ এক বছরের বেশি সময় ফেসবুক হ্যাক হয়ে থাকলেও মামলা না করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি স্পষ্ট করে কোনো বক্তব্য দেননি। 

এদিকে সুলতানা জেসমিনকে আটক থেকে হাসপাতালে ভর্তি এবং লাশ দাফন—সবই হয়েছে র‍্যাবের তত্ত্বাবধানে। দাপ্তরিক সকল কাগজপত্রেই র‍্যাব সদস্যদের নাম রয়েছে। আইনগত প্রক্রিয়ার কারণে কিছু কাজ পুলিশ সম্পন্ন করেছে। আটকের পর জেসমিনকে দুপুরে নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এরপর রাত ৯টা ২০ মিনিটে তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রথমে রামেক হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয় জেসমিনকে। রোগীর রেজিস্টারে লেখা হয়েছে, ‘সুলতানা জেসমিন, কেয়ার অব সাহেদ, গ্রাম-র‍্যাব-৫ ’। তবে জেসমিনের মৃত্যুর পর রেজিস্টার খাতায় জেসমিনের নাম ঠিক রেখে কেয়ার অব মনোয়ার হোসেন, গ্রাম-হাজি মনসুর রোড, খাস নওগাঁ, নওগাঁ সদর লেখা হয়। এই ঠিকানা সংশোধনের তারিখ ২৪/৩/২০২৩। খাতায় লেখা ফোন নম্বরটিও র‍্যাবের একজন নারী সদস্যের। আনসার ব্যাটালিয়ন থেকে আসা ওই নারী র‍্যাবে কর্মরত। 

এদিকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) জেসমিন মারা যাওয়ার পর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রাজপাড়া থানায় খবর দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওয়ার্ড মাস্টারের ডেথ রেজিস্টারের খাতায় নাম লেখার সময় জেসমিনের আত্মীয়দের খোঁজ করে কর্তৃপক্ষ। তাঁর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোন নম্বরও চাওয়া হয়। কিন্তু তখন জেসমিনের কোনো আত্মীয় সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। এ সময় উপস্থিত র‍্যাবের একজন সদস্য একটি মোবাইল নম্বর দেন। জেসমিনের নামের সঙ্গে লেখা ওই নম্বরও র‍্যাবের একজন এসআইয়ের। ডেথ রেজিস্টার থেকে নম্বর নিয়ে কল করা হলে রিসিভ করে নিজের নাম মাসুম বিল্লাহ ও র‍্যাব-৫ কর্মরত এসআই বলে পরিচয় দেন। তবে এসআই মাসুম বলেন, ‘ওই দিন আমি হাসপাতালে যাইনি। কেউ হয়তো আমার নম্বরটা লিখে দিয়েছে।’ 

এ বিষয়ে র‍্যাব-৫ এর রাজশাহীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার বলেন, ‘রামেক হাসপাতালে নেওয়ার সময় জেসমিনের সঙ্গে তাঁর দুলাভাই আমিনুল ছিলেন। তবে ভর্তি থেকে ডেথ রেজিস্টার বা অন্যান্য ক্ষেত্রে জেসমিনের নিকটাত্মীয় কারও মোবাইল নম্বর কেন দেওয়া হয়নি, তা জানি না।’ 

সুলতানা জেসমিনের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের এখনো তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরিতে আরও সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান কফিল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘মৃতদেহ থেকে নেওয়া নমুনার পরীক্ষা চলছে। এসবের রিপোর্ট এলে ময়নাতদন্তের চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রস্তুত করা হবে।’

আরও খবর পড়ুন:

রাকসুর জিএসকে ‘হত্যার হুমকি’ দিয়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতার ফেসবুক পোস্ট

বগুড়ায় ট্রাক-অটোরিকশার সংঘর্ষে চালক নিহত, আহত তিন

গভীর নলকূপ খনন: বরেন্দ্রজুড়ে শত শত মৃত্যুকূপ

শিশু সাজিদের শেষ বিদায়ে হাজারো মানুষের ঢল

আমার একটা কলিজা হারায় ফেলছি, বিচার চাই: সাজিদের বাবা

প্রাথমিকে শতভাগ বই, মাধ্যমিকে এল অর্ধেক

সব চেষ্টা—আকুতি বিফলে, মায়ের কোলে মৃত সাজিদ

শিশু সাজিদ মারা গেছে

শিশু সাজিদকে উদ্ধার, নেওয়া হয়েছে হাসপাতালে

শিশু সাজিদের বাঁচার আশা নেই, বন্ধ করা হয়েছে অক্সিজেন