‘খবরে হোনলাম বড় একটা বান (ঝড়) আইতে আছে। বানের কথা হোনলে চোহে মোহে আর ঘুম থাহে না। বাড়ির কূলে বেড়িবাঁধ ভাঙা। ৩২ বছরের জীবনে ৩০ বার দোকান ও ঘর বাড়ি সরাইছি। সরকার ওপদ্যা (বেড়িবাঁধ) দেয় আর ভাইঙ্গা যায়। এইবার বান (বন্যা) আইলে কোম্মে যামু আল্লাহ যানে, নদীতে ভাসা ছাড়া আর উপায় নাই।’
কথাগুলো বলেছিলেন পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার পিঁপড়াখালী গ্রামের পায়রা নদীর বেড়িবাঁধ এলাকার বাসিন্দা মো. হারুন সিকদার। গত ৭ মে পায়রা নদীর ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের খোঁজ খবর নিতে গেলে কথা হয় ওই এলাকার হারুন শিকদারসহ অনেক বাসিন্দাদের সঙ্গে।
প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পেলেই আতঙ্কে দিন পার করে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ, রাঙ্গাবালী ও কলাপাড়া উপজেলার হাজারো পরিবার। এসব এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকার ফলে জোয়ারের পানি কিংবা ঘূর্ণিঝড় আসলেই ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ ভেঙে মুহূর্তের মধ্যেই শত শত গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় এসব এলাকার ফসলি জমিসহ হাজারো পরিবার। এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর আভাস দিয়েছে আগামী ১৩-১৫ মে এর মধ্যে উপকূলীয় এলাকায় আঘাত আনতে পারে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’। পূর্বাভাসের পর থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে ভীত হয়ে পড়েছেন উপকূলের হাজারো পরিবার।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য মতে, পটুয়াখালী জেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ রয়েছে ১ হাজার ৩৩৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে পটুয়াখালী সার্কেলের অধীনে ৮২২ কিলোমিটার এবং কলাপাড়া উপজেলা সার্কেলের অধীনে রয়েছে ৫১৩ কিলোমিটার। এ ছাড়া পোল্ডার রয়েছে ৩৬টি। এর মধ্যে পটুয়াখালী সার্কেলে ১৯টি এবং কলাপাড়া সার্কেলে ১৭ টি।
এ ছাড়া জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ রয়েছে ১০ কিলোমিটার। ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ রয়েছে ১৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে পটুয়াখালী সার্কেলে ১০ কিলোমিটার এবং কলাপাড়া সার্কেলে ৮ কিলোমিটার। আংশিক ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ রয়েছে ৩৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে পটুয়াখালী সার্কেলে ১৯ কিলোমিটার এবং কলাপাড়া সার্কেলে ১৫ কিলোমিটার। জেলার সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ রয়েছে মির্জাগঞ্জ উপজেলায়।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ এর পূর্বাভাস পেয়ে এরই মধ্যে জমির ধান কেটে ঘরে তুলেছে উপকূলের কৃষকরা। যাতে করে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ এলাকার বাসিন্দারা তাঁরা তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ মালামাল সরিয়ে নিচ্ছে।
রাঙ্গাবালীর উত্তর চালিতাবুনিয়া গ্রামের মো. ফাহিম হোসেন বলেন, ‘ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে অন্তত: ৫টি গ্রাম তলিয়ে যায় এবং পানি ঢুকে পড়ে মানুষের ঘরবাড়িসহ পুকুর, ধান খেতে। অর্থাৎ জোয়ারে ডুবে থাকে এবং ভাটায় জেগে ওঠে এ ইউনিয়নটি। এভাবে চলে দিনে-রাইতে দুই বার। এ ছাড়া যখন ঝড়ের পূর্বাভাস পাই তখন ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটে আমাদের।’
চরমোন্তাজ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ, কে সামশুদ্দিন আবু মিয়া বলেন, ‘চরমোন্তাজ ইউনিয়নে প্রায় ৪৫ হাজার লোকের বসবাস। ইউনিয়নটির সাগরের একেবারে কাছে হলেও অনেক স্থানে নেই কোনো বেড়িবাঁধ। যার ফলে ঝড় বন্যা হলে আমরা এ এলাকার মানুষ আতঙ্কে থাকি।’
মির্জাগঞ্জের ইউনিয়নের মিলন মিয়া বলেন, ‘এই নদীতে আমার বাবা ও মায়ের কবর নিয়ে গেছে তাদের কোথায় কবর দিয়েছি সেই জায়গাটা পর্যন্ত এখন বলতে পারি না। আবার জোয়ার আইলে আমরা আর বাঁচতে পারমু না।’
কলাপাড়ার লালুয়া ইউপির চেয়ারম্যান মো. শওকত হোসেন তপন বিশ্বাস বলেন, ‘ভাই দুঃখের কথা আর কত বলবো। শুনলাম ঘূর্ণিঝড় মোখা আসতেছে। ঝড় বন্যা হলেই ভাঙা বেড়িবাঁধ নিয়ে আতঙ্কে থাকি আমরা। আজ ১৪-১৫ বছর ধরে একই অবস্থায় চলছে এ ইউনিয়নটির মানুষজন। তারপরও আমাদের এ দুর্ভোগ-দুর্দশা লাঘবের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেউ।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন বলেন, ‘এ জেলায় বেড়িবাঁধের সংখ্যা সবথেকে বেশি। এখানে ৩৬টি পোল্ডার ও ১ হাজার ৩৩৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এখানে যেহেতু সংখ্যা বেশি লেন্থ ও বেশি কাজের ঝুঁকি ও বেশি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দিকনির্দেশনা রয়েছে ঘূর্ণিঝড় মোখা আসার আগেই সব বেড়িবাঁধ সংরক্ষণ করা হবে। ইতিমধ্যে কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে।’
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সুমন চন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘আমাদের ৭০৩ টির বেশি ঘূর্ণিঝড় সাইক্লোন সেন্টার প্রস্তুত রয়েছে। যেখানে ২ লাখের বেশি মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। এ ছাড়া জেলায় ৫১টি মুজিব কেল্লার বরাদ্দ ছিল। ইতিমধ্যে ২৬টি মুজিব কেল্লা উদ্বোধন হয়ে গেছে বাকিগুলোর কাজ চলছে।’