মানিকগঞ্জের নদীতে এগিয়ে চলছে বাহারী আকৃতির নৌকা। হরেক রঙের পোশাকে মাঝি-মাল্লাদের সমবেত কণ্ঠের 'হেইয়ো হেইয়ো' সারিগান। দুপাড়ে হাজার হাজার দর্শকদের উত্তেজনা। সবার উৎসুক দৃষ্টি আর মূর্হমূহ চিৎকার-করতালি। নির্মল আনন্দের খোরাক এই নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার দৃশ্য মনোমুগ্ধকর।
জানা যায়, নদীর এই জলতরঙ্গের সঙ্গে মানিকগঞ্জের মানুষের মিতালি শৈশবকাল থেকে। নৌকাবাইচের এ রীতি এ অঞ্চলে অনেক প্রাচীন। মানিকগঞ্জবাসী করোনার কারণে দীর্ঘদিনের স্থবির ছিল। জীবনের এ স্থবিরতা কাটিয়ে ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচে আবারও মেতে উঠেছে তারা।
এলাকার একাধিক নৌকাবাইচের মালিক জানান, বাইচের নৌকা হয় সরু ও লম্বা। কারণ, সরু ও লম্বা নৌকা নদীর পানি কেটে দ্রুতগতিতে চলতে পারে। বিভিন্ন আকৃতির বহু নৌকা সমবেত হলে শুরু হয় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা। ছিপ, বজরা, ময়ূরপঙ্খী, গয়না, পানসি, কোষা, ডিঙি, পাতাম, বাচারি, রপ্তানি, ঘাসি, সাম্পান নামের নৌকা থাকে এ প্রতিযোগিতায়।
একেকটি নৌকা লম্বায় প্রায় ১০০ থেকে ২০০ ফুট হয়। এসব নৌকার সামনে সুন্দর করে সাজানো হয়। এতে থাকে ময়ূরের মুখ, রাজহাঁসের মুখ বা অন্য পাখির মুখের অবয়ব। পাশাপাশি নৌকাকে দৃষ্টিগোচর করতে উজ্জ্বল রঙের কারুকাজ করা হয়।
এই মৌসুমে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় কমপক্ষে অর্ধশত নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ঘিওর উপজেলার কলতা কান্তাবতি নদীতে দুই’শত বছরের ঐতিহ্য নৌকা বাইচ, হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা ইছামতী নদীতে, দৌলতপুর উপজেলার চকমিরপুর ইউনিয়নের সমেতপুর বিলে, শিবালয় উপজেলার আরুয়া ইউনিয়নের দড়িকান্দি-নয়াকান্দি ইছামতী নদীতে, হরিরামপুর উপজেলার সাপাই দিয়াবাড়ি বিল, সিংগাইর উপজেলায় চান্দহরে ধলেশ্বরী, বলধারা রামকান্তপুর এবং ঘিওর উপজেলায় পেঁচারকান্দা-কুশুন্ডা-জাবরা এলাকায় ইছামতী নদীতে, মানিকগঞ্জ শহরের বেউথায় কালিগঙ্গা নদীতে, সদর উপজেলার বালিরটেক কালিগঙ্গা নদীতে অনুষ্ঠিত হয় এই নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা।
এই প্রতিযোগিতায় রং বেরঙের বাহারি নৌকা আর হাজারো উৎসুক দর্শকের ভিড়ে নদী হয়ে উঠে উৎসব মুখর। নদীর দু’পাড়ে নৌকা বাইচ দেখতে দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষের আগমন ঘটে।
জেলার ঘিওর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অহিদুল ইসলাম টুটুল বংশ পরম্পরায় ঐতিহ্য ধরে রাখতে সুদৃশ্য বাইচের নৌকা পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন। তিনি বলেন, অনেক খরচের পরও শখ আর ঐতিহ্য ধরে রাখতে তাদের এই আয়োজন।
এ বিষয়ে তার বংশধর মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, তাদের নৌকার নাম ছিল হাজি সবেদ এন্টারপ্রাইজ। শুধু শৌখিনতা আর পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতেই তার দাদা জমি বিক্রি করেছিলেন।
এ বিষয়ে লোকজ ঐতিহ্য উন্নয়ন ও গবেষক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, নৌকাবাইচ সমন্ধে মানিকগঞ্জের মানুষের মাঝে জনশ্রুতি আছে, জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রার সময় স্নানার্থীদের নিয়ে বহু নৌকার ছড়াছড়ি ও দৌড়াদৌড়ি পড়ে যায়। এতেই মাঝি-মাল্লা-যাত্রীরা আনন্দ পায়। এ থেকে কালক্রমে নৌকাবাইচের প্রতিযোগিতা শুরু।
এ বিষয়ে হরিরামপুরের কালোই এলাকার মাল্লার সর্দার ছিলেন আব্দুল করিম বলেন, নৌকার মধ্যে ঢোল, তবলা, টিকারা নিয়ে গায়েনরা থাকেন। তাঁদের গানগুলো মাল্লাদের উৎসাহ আর শক্তি জোগায়। বাজনার তালে নৌকাবাইচে মাঝি-মাল্লারা একসুরে গান গেয়ে ছুটে চলেন। এতে নৌকার কোনো বইঠা ঠোকাঠুকি না করে একসঙ্গে পানিতে অভিঘাত সৃষ্টি করতে থাকে। গায়েন বা পরিচালক কাঁসার শব্দে এই বইঠার এবং গানের গতি বজায় রাখেন।
ঘিওর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট ক্রীড়া পৃষ্ঠপোষক অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান হাবিব নৌকাবাইচের স্মৃতিচারণ করে জানান, আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য নৌকাবাইচ নানা প্রতিকূলতার পথ পাড়ি দিয়ে আজ ক্লান্ত। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে মেহনতি মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা আর আনন্দের নৌকাবাইচ। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য সংরক্ষণে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।