আত্মানুসন্ধানের বেরিয়ে পড়েছিলেন ফরাসি দেশের রাজধানী প্যারিসের মেয়ে দেবোরাহ কিউকারম্যান। ৫০টির বেশি দেশ ঘুরে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসে পড়েন বাংলাদেশে। লক্ষ্য ফকির লালন শাহের আখড়া। লালনের দর্শনে মুগ্ধ দেবোরাহ আর বাড়ি ফেরেননি। এখানে ঘর বেঁধেছেন। তিনি এখন বাংলাদেশি বধূ। তিনি এখন দেবোরাহ জান্নাত। সাধুসঙ্গই তাঁর দৈনন্দিন রুটিন।
২০১৭ সালে লালনের তিরোধান দিবসে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার রাজন ফকিরকে বিয়ে করেন দেবোরাহ। রাজন ফকির উপজেলার প্রাগপুর ইউনিয়নের দীঘিরপাড় এলাকার ফকির গুরু নহির শাহ্র ভাতিজা ও শিষ্য। এখন জায়গাটি ‘হেম আশ্রম’ নামেই পরিচিত।
বিদেশি এই নারীর সাবলীল বাংলায় কথা বলা ও লেখায় মুগ্ধ হবেন যে কেউ। বাঙালি নারীদের মতো চলাফেরাও রপ্ত করেছেন। পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব দেবোরাহের সঙ্গে কথা হয় আজকের পত্রিকার এ প্রতিবেদকের। কেন বাংলাদেশে আসা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে সাধুসঙ্গ দেখতে এসেছি দুইটা লক্ষ্যে—ব্যক্তিগত কৌতূহল ও পিএইচডি গবেষণার জন্য। কিন্তু শেষ বেলায় সিদ্ধান্ত নিতে হলো কোনটা আমার জন্য বেশি জরুরি—সামাজিক আর একটা সার্টিফিকেট অর্জন করা নাকি গুরুকে ধরে সত্যিকারে ভক্ত হওয়া। এ সময় সাধু বা সাধকের আধ্যাত্মিকতা দেখে প্রেমে পড়ে যাই লালনের। খ্যাতি ও অর্থের মোহ পিছু ঠেলে থেকে যাই এ দেশে। মাঝে মধ্যে মাতৃভূমি ও পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে প্যারিসে যাই।’
ফ্রান্সিস ও লিন্ডা কুকিয়েরমানের মেয়ে তিনি। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। ২০০৭ সালে লন্ডন কিংস্টোন ইউনিভার্সিটি থেকে নৃতত্ত্বে স্নাতক। দেশে থাকাকালীন ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদের কাজও করতেন। দর্শনে এমএ করে ফ্রান্সে একসময় যোগের শিক্ষকতাও করেছেন।
আমি কে—এই প্রশ্ন নিয়ে তিনি কেন ঘুরেছেন, এর জবাবে দেবোরাহ বলেন, ‘কারণ, নিজের পরিচয় সবাই দেখাতে পারে কিন্তু কোনটা সত্য সেটা বেছে নিতে হয়। প্যারিসে ছেলেবেলা কাটিয়েছি, বড় হয়েছি, অনার্স পড়েছি, লন্ডন-আমেরিকাতে থেকেছি। আমি একসময় সিনেমাতে কাজ করতাম। আর সব সময় যোগের মধ্যে একটা সাধনা ছিল। সাধনা এতই বেশি হয়ে যায় তখন চাকরি ত্যাগ করে যোগেই মনোযোগী হই। ওই সময়টাতে আরও বেশি করে মনে প্রশ্ন জাগে “কে আমি? ” আসলে প্রশ্নের কোনো শেষ নেই। শেখারও শেষ নেই। তখন ফ্রান্স ছেড়ে চলে আসি ভারতে একটা আশ্রমে, যেখানে ধ্যান সাধনা শেখান হয়। গবেষণা করতে ও নিজের সাধনায় আরও গভীরে যেতে হয়। তারপর পথ খুঁজতে খুঁজতে প্রাগপুরের এই দীঘিরপাড়ে।’
দীঘিরপাড়ে তিনতলা বাড়ি করেছেন দেবোরাহ। স্বামীকে নিয়ে সুখেই আছেন। নিজের থাকার ঘরটিতে ফরাসি সংস্কৃতির ছোঁয়া। তাকে সাজানো সারি সারি বই। তাঁর কণ্ঠে লালন সংগীতও মনোমুগ্ধকর।
সাধুদের জীবনযাপন কেমন লাগছে? একটু গম্ভীর হয়ে যান দেবোরাহ। বলেন, ‘কেউ সহজে সাধু হয় না, কোন রহস্যে মনটা ব্যতিক্রম হয়, হৃদয়ের টান বেশি জোরে বাজায়। আমার ক্ষেত্রে মুখের কথা, চিন্তা-ভাবনা, ও কর্মকে মিলাতে গিয়ে সাধনায় পড়েছি। বিশ্বজুড়ে সাধারণ সমাজে যে অমিল থাকে এই তিনটি স্তরে, সেটা আমার কাছে অসহনীয় ছিল। ‘‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন’’ এই কথার ওপরে আর কোনো আদর্শ নেই আমার কাছে। কিন্তু সাধকের জীবন যাপন করতে গেলে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়, নিজের মধ্যে ও সমাজের সম্মুখে। সাধু হওয়া অনেক বড় একটা জিহাদ। তবু ভোগে সুখ নেই, ত্যাগে শান্তি।’
উল্লেখ্য, ফকির নহির শাহ্ বাংলাদেশের একজন প্রবীণ লালনভক্ত সাধক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালে উপজেলার প্রাগপুর ইউনিয়নের দীঘিরপাড়ে ‘হেম আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। আধ্যাত্মিক চর্চাই এখন তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত।