সারা দেশে ঘোষণা দিয়ে নতুন করে লোডশেডিং শুরু হয়েছে। শহর থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত এই লোডশেডিং চলছে। প্রশাসনের তরফ থেকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য নাগরিকদের অনুরোধ করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে এ সম্পর্কিত নানা উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি যাদের সামর্থ্য আছে, তারা বিকল্প শক্তির উৎসও খুঁজে বের করছে। এর মধ্যে মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রথম পছন্দ ইনস্ট্যান্ট পাওয়ার সাপ্লাই বা আইপিএস। কিন্তু বর্ধিত চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঠিক পেরে উঠছে না সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এক কথায় বলা যায় দেশের বাজারে আইপিএস রীতিমতো সোনার হরিণ হয়ে গেছে।
‘আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ যায় না বরং মাঝে মাঝে আসে।’ বিদ্যুৎবিভ্রাটে অতিষ্ঠ হয়ে একসময় মানুষ এভাবেই নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করত। বর্তমান পরিস্থিতি এখনো অবশ্য সে পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তবে মানুষ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করছে। শ্রেণিভেদে মোম, চার্জার লাইট ও ফ্যান এবং আইপিএসের চাহিদা বেড়েছে। বাজারে মোম বা চার্জার লাইট ও ফ্যানের জোগান থাকলেও চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে এসবের দাম। কিন্তু আইপিএসের ক্ষেত্রে ঘটনাটি এত সরল নয়।
আগেই বলা হয়েছে আইপিএস এখন সোনার হরিণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের প্রভাবে দেশে বিদ্যুৎবিভ্রাট বৃদ্ধি পাওয়ায় সামর্থ্যবান মানুষেরা এখন হন্যে হয়ে আইপিএস খুঁজছে। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আইপিএস কিনতে পারছেন না ক্রেতারা। ক্রেতারা বলছেন, বাজারে আইপিএসের সংকট রয়েছে। হাতেগোনা কিছু আইপিএস পাওয়া গেলেও দাম বেশ চড়া। কন্ট্রোল ইউনিট পাওয়া গেলে ব্যাটারি পাওয়া যায় না, আবার ব্যাটারি পাওয়া গেলে মেলে না কন্ট্রোল ইউনিট।
দেশের বাজারে ১৯৯৩ সালে প্রথম আইপিএস আনে রহিম আফরোজ গ্রুপ। রহিম আফরোজ ছাড়াও সিঙ্গার, বাটারফ্লাই, নাভানা, হ্যামকো, সনি, ফিলিপস, স্যামসাং, অনিক ব্রান্ডের আইপিএস দেশের বাজারে জনপ্রিয় হয়। স্থানীয় বাজারে আইপিএস ব্যবসা বেশ জমে ওঠে। কিন্তু দেশ বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় প্রেক্ষাপট বদলাতে থাকে। একসময়কার জমজমাট আইপিএস ব্যবসায় ভাটার টান পড়ে। কিন্তু এখন সে বাজারে আবার জোয়ার এসেছে। অনেকেই এখন আইপিএস কিনছেন বা কেনার চেষ্টা করছেন।
বিদ্যুৎবিভ্রাটে অতিষ্ঠ হয়ে সম্প্রতি আইপিএস কিনেছেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী জামাল উদ্দিন। রাজধানীর বনশ্রীর এই বাসিন্দা বলেন, ‘ডিপিডিসি ও ডেসকো বিদ্যুৎবিভ্রাটের যে সময় বেঁধে দিয়েছে, সেই শিডিউল মানা হচ্ছে না। রাত-দিন নেই, যখন-তখন বিদ্যুৎ যায় আর আসে। বাড়িতে বয়স্ক মা আছেন। তাই বাধ্য হয়েই আইপিএস কিনতে হয়েছে। ব্রান্ডের শোরুমে গিয়ে আইপিএস পাইনি। বাধ্য হয়ে লোকাল মার্কেটে ঘুরে আইপিএস কিনেছি।’
জামাল উদ্দিন বলেন, ‘ব্রান্ডের শোরুমে আইপিএস কিনতে গিয়েছিলাম। তারা বলেছে, আগামী কয়েক মাসেও বাজারে পর্যাপ্ত আইপিএস আসার তেমন সম্ভাবনা নেই। বাজারে আইপিএস এলেও দাম বাড়তি থাকতে পারে।’
জামাল উদ্দিন না হয় স্থানীয় পর্যায় থেকে কিনতে পেরেছেন, কিন্তু রাজধানীর পুরান ঢাকার বাসিন্দা হাসমত আলী চেষ্টা করেও এখনো কিনতে পারেননি। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এমনিতেই গরমে টেকা দায়। এর মধ্যে আবার লোডশেডিং। সামনে মেয়ের এসএসসি পরীক্ষা। নবাবপুর, পাটুয়াটুলীতে আইপিএস খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। একসময় আমার বাসাতেও আইপিএস ছিল। অনেক দিন পড়ে থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হই। আফসোস হয়, সেটাও যদি এখন থাকত, তাহলে মিস্ত্রি দিয়ে ঠিক করিয়ে অন্তত এই কষ্ট থেকে বাঁচা যেত।’
অর্থাৎ, বাজারে আইপিএসের চাহিদা থাকলেও সে অনুপাতে সরবরাহ নেই। রহিম আফরোজের ডিলার ডলফিন এন্টারপ্রাইজের এক কর্মকর্তা জানান, চাহিদার বিপরীতে সাপ্লাই না থাকায় তারা আপাতত অর্ডার নিতে পারছেন না। বিদ্যুৎবিভ্রাট ও তীব্র গরম মিলিয়ে চাহিদা অনেক বেশি। তারা জানান, চাহিদা হুট করে ১০ গুন বেড়ে গেলে আসলে কিছুই করার থাকে না।
এর কারণ জানতে চাইলে রহিম আফরোজের হেড অব বিজনেস নাওয়াজ রহিম বলেন, ‘সংকটটা একদম হঠাৎ করে এসেছে। কেউই এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। গত জুনে আইপিএস বিক্রি বাড়াতে অফার পর্যন্ত দিতে হয়েছিল। আর জুলাইয়ে এসে প্রেক্ষাপট পুরো ভিন্ন। ধারণার চেয়েও তিন-চার গুন বেশি বিক্রি হয়েছে। আরও বিক্রি হতো কিন্তু চাহিদার বিপরীতে সাপ্লাই না থাকায় সেটি সম্ভব হয়নি। ক্রেতাদের চাহিদা এখন অনেক বেশি।’
তবে সরবরাহের এই সংকট আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলে মনে করেন নাওয়াজ রহিম। তিনি বলেন, ‘আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে সংকট নিরসন হতে পারে। আশা রাখছি ক্রেতাদের চাহিদা পূরণে আমরা সক্ষম হব।’
কন্ট্রোল ইউনিটের চেয়ে ব্যাটারির সংকটই বেশি জানিয়ে নাওয়াজ রহিম বলেন, ‘কন্ট্রোল ইউনিট মূলত আমদানিনির্ভর। আমরা অর্ডার দিয়ে রেখেছি। কন্ট্রোল ইউনিট শিগগিরই চলে আসবে। আর ব্যাটারি দেশেই উৎপাদন হয়। শিশা এনে ব্যাটারি বানাতে সময় বেশি লেগে যায়। হঠাৎ চাহিদা বাড়ায় ব্যাটারি উৎপাদনে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
দাম বাড়বে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে রহিম আফরোজের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘দাম ৫ থেকে ৭ শতাংশ বাড়তে পারে। তবে সেটা বাড়বে ডলারের দাম বাড়ার কারণে। কন্ট্রোল ইউনিট আমদানি নির্ভর হওয়ায় এর দামে প্রভাব পড়বে।’
এদিকে সিঙ্গারের শো-রুমে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাদের কাছে খুব সীমিত সরবরাহ রয়েছে, চাহিদার বিপরীতে যা একেবারে অপ্রতুল। এই মুহূর্তে তাদের কাছে পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। তবে সামনে আসবে। যদিও সুনির্দিষ্ট কোনো সময়ের কথা জানাতে পারেননি প্রতিষ্ঠানটির বনশ্রী আউটলেটের ব্যবস্থাপক।
আসলাম রাজু বলেন, ‘মানুষ হন্যে হয়ে এখন আইপিএস খুঁজছে। এই সুযোগে অনেকেই নতুন করে এই ব্যবসায় নেমেছেন। ব্রান্ডের আইপিএসে সংকট থাকলেও লোকাল মার্কেটে সংকট হবে না। তবে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মানহীন আইপিএস তৈরির হিড়িক পড়তে পারে। এখনই অনেকে কপারের জায়গায় অ্যালুমিনিয়াম আবার অ্যালুমিনিয়ামের জায়গায় মানহীন তার দিয়ে কোনোমতে আইপিএস বানাচ্ছে। এসব আইপিএস কেনার ৬ মাস না যেতেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে।’
নতুন করে আর এই ব্যবসায় জড়ানোর ইচ্ছা নেই জানিয়ে আসলাম রাজু বলেন, ‘অনেক দিন ধরে আমি যেহেতু এই পেশাতে নেই, তাই আমার আপাতত এ ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা নেই। যারা বিনিয়োগ করছেন, তাঁরাও অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই করছেন। কারণ বিদ্যুৎবিভ্রাটের যে সংকট, সেটি কেটে গেলে তাঁরা বড় লোকসানে পড়বেন।’