ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম পুরোনো শাড়ি, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট আর নোটবুকসহ কিছু পত্রিকার কাটিং। বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রীসহ আছে ক্যামেরায় তোলা নানান ছবি—যা সুতোয় বেঁধে ঝোলানো কিংবা দেয়ালে সাঁটানো। এসবের সামনে সমুদ্র গভীর চোখ নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ১৫ বছরের এক কিশোর। উজ্জ্বল ফরসা, পাতলা গড়নের লম্বাটে গায়ে কালো টি-শার্ট জড়ানো কিশোরের নাম মাহির সরওয়ার মেঘ।
গভীর সমুদ্রের আকাশে জমে থাকা মেঘের মতো গুমোট ও দুর্বোধ্য তার দৈহিক ভাষা। যা বোঝা খুব সহজ নয়। বোঝা যাবেই-বা কীভাবে! কারণ, মাহির সরওয়ার মেঘ যে এসব সাজিয়ে রাখা জিনিসপত্রের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতিতে হাতড়ে খুঁজছে তার মা-বাবাকে।
১১ বছর আগে খুন হলেও সাগর-রুনির হত্যা মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। কোনো কূলকিনারাই করতে পারেনি দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্তকারী সংস্থা। তাই বিচারের দাবিতে এই সাংবাদিক দম্পতির পরিবার আয়োজন করেছে এক ভিন্নধর্মী চিত্র প্রদর্শনীর। রুনির ভাই নওশের রোমানের তত্ত্বাবধানে রাজাবাজারের ইন্দিরা রোডের ‘সাগর-রুনি ক্রাইম সিন ডু নট ক্রস’ দিনব্যাপী এই প্রদর্শনী চলছে। সাগর-রুনির ব্যবহার করা বিভিন্ন জিনিসপত্র দিয়ে ১০ জন শিল্পী বেশ কিছু চিত্রকর্ম বানিয়েছেন। প্রদর্শন করা হয়েছে তাঁদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও ছবি। সে সবই ঘুরে ঘুরে দেখছিল মেঘ সঙ্গে তার এক বন্ধু। যে বয়সে বন্ধুরা এলে মা-বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা। সেই বয়সে মেঘ তার মা-বাবার রেখে যাওয়া স্মৃতিচিহ্নের সঙ্গে বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। দুটি ঘরে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। প্রথম ঘরটিতে মূলত ব্যবহার করা জিনিসপত্র দিয়ে বানানো শিল্পকর্মগুলো রাখা। এই ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়বে বড় এক গ্রিলের জানালা। কাঠ আর কাচের পাল্লার এই জানালায় মেঘের সাত-আট বছর বয়সী চারটি পোর্ট্রেট ছবি সাঁটানো। জানালা থেকে সোজা মেঝের দিকে কাগজ দিয়ে বানানো চার জোড়া পা। প্রথম দেখায় মনে হবে ছোট্ট মেঘ জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে তার মা-বাবাকে দেখছে। দরজা থেকে কয়েক পা বাড়িয়ে হাতের বাঁ দিকে তাকালে চোখে পড়বে ছোট্ট বেলকনির দরজা। দরজার দুই পাল্লায় সাগর ও রুনির ছবি সাঁটানো।
বেলকনির দড়িতে রোদে দেওয়া কাঁচা হলুদ শাড়ি। এই বেলকনির দরজার কার্নিশে রাখা রুনির ব্যবহার করা প্রসাধনী সামগ্রী। দেখে যেন মনে হবে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রোদ পোহাচ্ছেন মেঘের মা-বাবা। এসব চিত্রকর্ম বন্ধুদের দেখিয়ে প্রয়াত মা-বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে মেঘ।
এক ফাঁকে কথা হয় তার সঙ্গে। পড়াশোনা আর শখের ক্রিকেট প্র্যাকটিস করে তার দিন কাটে। পরীক্ষার কারণে এখন ক্রিকেট প্র্যাকটিসে কম সময় দেওয়া হচ্ছে। মেঘ বলে, ‘আজ এই প্রদর্শনী নিয়ে দিন কাটবে। বন্ধুরা আসছে তাদের সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি। কোন চিত্রকর্মটা কী বোঝাচ্ছে, সেটাও বলার চেষ্টা করছি।’
আর একটি ঘরে কয়েকটি মনিটরে দেখানো হচ্ছে সাগর-রুনিকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংবাদ। ঘরের এক কোনায় ছোট্ট একটি টেবিলে রাখা সাগর-রুনি ও মেঘের ফ্রেমে বাঁধানো দুটি ছবি। আর দুটি খাতার সঙ্গে রাখা আছে কয়েক রঙের কালির কলম। প্রদর্শনী দেখতে এসেছে মেঘের স্বজন, সাগর-রুনির বন্ধু ও সহকর্মীরা।
মেঘের স্বজন পরিচয়ে আরেকজন লিখেছেন, ‘দীর্ঘ ১১ বছর ধরে যে বিচার কার্যক্রম হয়নি, আমরা চাই তার সুষ্ঠু বিচার কার্যক্রম হোক। তাহলে আমরা সুষ্ঠু বিচার পাব।’