সুনামগঞ্জ টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে গিয়ে গত রোববার গ্রেপ্তার হন বুয়েট শিক্ষার্থীসহ মোট ৩৪ জন। তাঁদেরকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় পরদিন সোমবার কারাগারে পাঠানো হয়। আজ মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে গ্রেপ্তার বুয়েট শিক্ষার্থীদের স্বজনেরা দাবি করেছেন, তাঁরা কোনো ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত নয়।
বুয়েটের শহীদ মিনারের পাদদেশে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন গ্রেপ্তার শিক্ষার্থী আলী আম্মার মুয়াজের বড় ভাই আলী আহসান জুনায়েদ।
লিখিত বক্তব্য পাঠকালে আলী আহসান জুনায়েদ বলেন, ‘আমরা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, কোনো ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের সঙ্গে আমাদের সন্তানেরা জড়িত নয়। ছোটবেলা থেকে মেধাবী ছাত্র হিসেবে এবং ভালো সন্তান হিসেবে আমরা তাঁদের ব্যাপারে গর্ব অনুভব করি। ছোটবেলা থেকেই তাঁদের পড়ালেখার প্রতি ঝোঁক ছিল; রাজনীতিসহ এ জাতীয় কোনো কাজের সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা ছিল না কখনোই।
‘উপরন্তু, বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ায় আমরা সর্বদাই তাঁদের এ ব্যাপারে সাবধান করে গিয়েছি এবং তাঁরাও রাজনীতিমুক্ত হিসেবেই ছিল। অতএব, তাঁরা কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, এ ধরনের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলছি তাঁরা সাধারণ শিক্ষার্থীমাত্র। কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তাঁদের বিরুদ্ধে এমন ভয় মামলা সাজানো হলো, আমাদের বোধগম্য নয় বলে উল্লেখ করেন আলী আহসান জুনায়েদ।’
তিনি বলেন, ‘গত ২৯ জুলাই (শনিবার) আমাদের সন্তান/স্বজনেরা ক্যাম্পাসের বন্ধুদের সঙ্গে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে যায়। যাওয়ার পরে সুনামগঞ্জ গিয়ে আরও বেশ কয়েকজন বুয়েটিয়ানকে পেয়ে তারা আনন্দিত হয় এবং তারা সবাই একত্রে ঘোরার কথা জানায়। রোববার সন্ধ্যার পর থেকে তাদের ফোনে না পাওয়ায় আমরা মনে করেছি—ট্যুরে আছে, হাওর এলাকায় হয়তো নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে ফোনে কল যাচ্ছে না। দীর্ঘক্ষণ তাদের ফোনে না পেয়ে আমরা শঙ্কিত হই। এরপর প্রায় ৩ ঘণ্টা পরে রাত ১০টার দিকে হঠাৎ ফোন করে আমাদের অনেকের কাছেই সন্তানরা তাদের নিজের ও গার্ডিয়ানের ন্যাশনাল আইডি কার্ডের নম্বর জানাতে চায়। তারা জানায় যে, পুলিশ হাওরে নৌকায় ভ্রমণের সময় জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে আটক করে তাহিরপুর থানায় নিয়ে এসেছে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করেছে; এরপর আইডি কার্ডের নম্বর নেওয়ার পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে।
‘তাঁরা ফোনে শুধু এতটুকুই বলতে পারে। কিন্তু বেশি আর কথা বলতে দেওয়া হয়নি, ফোন নিয়ে নেওয়া হয়। ফলে আমরা এর পর থেকে তাঁদের বিষয়ে খোঁজখবর জানার জন্য ওসি ও এসপিকে বারবার ফোন করেছি, কিন্তু তাঁরা কেউ ফোন রিসিভ করেননি।’
জুনায়েদ আরও বলেন, ‘কেন তাদের আটক করা হয়েছে তা আমরা জানতে পারছিলাম না। অনেক উদ্বিগ্নতার পরে গতকাল বিকেলে সংবাদমাধ্যমের বরাতে আমরা জানতে পারি যে, তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। তারা নাকি নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনার জন্য সেখানে গেছে। আমাদের সন্তানদের ব্যাপারে এমন অকল্পনীয় অভিযোগ শুনে আমরা যারপরনাই আশ্চর্যান্বিত হই। আমরা মনে করি, এ রকম হাস্যকর ও বানোয়াট অভিযোগ সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও দুরভিসন্ধিমূলক।’
আলী আহসান জুনায়েদ আরও বলেন, ‘স্থানীয় ওসি এবং এসপিকে ফোন দেওয়ার পাশাপাশি আমরা রাত থেকে ভিসি স্যারকেও (অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার) ফোন দিয়েছি অসংখ্যবার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা কারও সঙ্গেই যোগাযোগে সক্ষম হইনি। গতকাল বিকেলে আমাদের হাতে পৌঁছানো মামলার বিবরণীতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ঘটিয়ে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, জানমালের প্রতি ক্ষতিসাধন, রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডসহ ধর্মীয় জিহাদ সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অপরাধ ইত্যাদি অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই পুরো বিষয়টি আমাদের প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এমন বাস্তবতায় গতকাল সন্ধ্যায় আমরা কয়েকজন অভিভাবক বিচ্ছিন্নভাবে বুয়েট ক্যাম্পাসে আসি ভিসি মহোদয়ের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে।’
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, জব্দকৃত মালামাল হিসেবে কতগুলো জিনিসপত্র তাদের কাছ থেকে উদ্ধারের যে প্রসঙ্গ অবতারণা করা হয়েছে, এটি অত্যন্ত হাস্যকর এবং পরিষ্কারভাবে বানোয়াট বিষয়। তারা টার্ম-ব্রেকের ছুটির মাঝে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ঘুরতে ওখানে গেছে। সঙ্গে সদ্য এসএসসি পাসকৃত কয়েকজন আত্মীয়কেও বেড়ানোর জন্য সঙ্গে নিয়ে গেছে। এভাবে টাঙ্গুয়ার হাওরে যেয়ে কেউ নাশকতার পরিকল্পনা করবে এমন অভিযোগও হাস্যকর। পরবর্তীতে কোর্টে তোলার সময়ে আইনজীবীদের তাঁরা জানিয়েছেন যে, তাদের কাছে এবং সঙ্গে থাকা মোবাইলে মামলার জব্দ তালিকায় উল্লেখিত উক্ত মামলা সাজাতে পুলিশের যেসব কাগজপত্র প্রত্যাশিত, সেসবের কিছুই না পেয়ে তাদের সামনেই জব্দকৃত সেসব অনাকাঙ্ক্ষিত মালামাল সংগ্রহ করা হয়েছে এবং মামলা সাজানোর জন্য ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড দিয়ে প্রিন্ট করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন আলী আহসান জুনায়েদ।
মামলার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে জুনায়েদ বলেন, ‘এমন এক আইনে তাদের ফাঁসানো হয়েছে, আইনজীবীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলে জানতে পেরেছি হাইকোর্টে নিয়ে আসতে হবে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, আপনাদের (গণমাধ্যম) সহযোগিতা চাই।’
সবাই বুয়েট থেকে একসঙ্গে গিয়েছিল কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে জুনায়েদ বলেন, ‘তারা অ্যাডাল্ট ছেলে, তারা ট্যুরে যাবে! সে হিসেবে তারা ঘুরতে গিয়ে বাকি অনেকের সঙ্গে মিলিত হয়ে একসঙ্গে ঘোরাঘুরি করছে। এখান থেকে একসঙ্গে কতজন গিয়েছে তা তো আমরা জানি না। অ্যাডাল্ট ছেলে হিসেবে ঘুরতে যাচ্ছে, সে হিসেবে টাকা চায়। কিন্তু কতজন যায় এটা তো জানার বিষয় আমাদের (অভিভাবক) হয় না।’
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন গ্রেপ্তার আফিফ আনোয়ারের বাবা আনোয়ারুল হক, সাকিব সারোয়ারের বাবা জামাল উদ্দিন চৌধুরী, বাকি বিল্লাহর বড় ভাই আরিফ বিল্লাহ প্রমুখ।