সাজ্জাদ আলী ওরফে বড় সাজ্জাদ দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে চট্টগ্রামে পরিচিতি পান ২৬ বছর আগে। তখন সরোয়ার হোসেন বাবলা, নুরনবী ম্যাক্সন, আকবর আলী ওরফে ঢাকাইয়া আকবর ও ছোট সাজ্জাদকে নিয়ে সন্ত্রাসী দল গড়েন বড় সাজ্জাদ। একসময় উল্লিখিত ব্যক্তিদের হাতেই ছিল চট্টগ্রামের অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ম্যাক্সন, সরোয়ার ও আকবর আলী বড় সাজ্জাদের সঙ্গ ছেড়ে আলাদাভাবে পথচলা শুরু করেন ১০ বছর আগে। এ অবস্থায় ২০১৫ সাল থেকে বড় সাজ্জাদের কমান্ডে ছোট সাজ্জাদ দলের হাল ধরেন। পরে ভারতে ম্যাক্সনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। সরোয়ার ও আকবর বড় ও ছোট দুই সাজ্জাদের নিশানায় পড়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে এ-সংক্রান্ত মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে গত ২৯ মার্চ নগরের বাকলিয়া অ্যাকসেস রোড এলাকায় প্রাইভেট কারে গুলি চালিয়ে সরোয়ারকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ওই সময় প্রাইভেট কারে থাকা তাঁর দুই সহযোগী বখতিয়ার হোসেন মানিক (৩০) ও মো. আবদুল্লাহ (৩৬) ঘটনাস্থলে মারা যান। সেই থেকে সরোয়ার হোসেন বাবলা বিদেশে চলে যাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে তদবির করে তিনি পুলিশের সংশ্লিষ্ট শাখায় তিন মাস ধরে চেষ্টা করেছেন বলে জানান বাবলার ছোট ভাই মো. আজিজ। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। ২০২০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কাতার থেকে দেশে ফিরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হন সরোয়ার। এরপর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সরোয়ারের পাসপোর্ট ব্লক (বন্ধ) করে দেয় বলে জানান মো. আজিজ।
সরোয়ারের আরেক সহযোগী নগরের বিভিন্ন থানার হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজির ১০টি মামলার আসামি আলী আকবর ওরফে ঢাকাইয়া আকবরকে গত ২৩ মে রাত সাড়ে ৮টার দিকে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় উপর্যুপরি গুলি চালিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। দুই দিন পর ঢাকাইয়া আকবর মারা যান। কারাগারে বন্দী সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদ হোসেনের অনুসারীরা আকবর হত্যার পেছনে রয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। সহযোগীর এই ধরনের টার্গেটেড হত্যাকাণ্ডে বিদেশে যাওয়ার জন্য আরও ব্যাকুলতা বাড়ে সরোয়ার হোসেন বাবলার। এর মধ্যে একের পর এক প্রাণনাশের হুমকি আসতে থাকে বড় সাজ্জাদ ও রায়হানদের কাছ থেকে। কেউ সাত দিন, কেউ তিন দিনের মৃত্যুর পরোয়ানা পাঠায় সরোয়ারকে। এরই মধ্যে গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিয়ের পিঁড়িতে বসেন সরোয়ার। বিয়ের পর স্ত্রীসহ পরিবারের সবাই জোর করছিল সরোয়ারকে বিদেশে চলে যেতে। জীবন বাঁচাতে সরোয়ারও বিদেশে চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পাসপোর্টের ব্লক খুলতে পারছিলেন না। শেষতক মৃত্যুই সরোয়ারের জীবনের সমাধান দিল বলে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তাঁর ছোট ভাই মো. আজিজ।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (বিশেষ শাখা) মো. গোলাম রুহুল কুদ্দুস আজকের পত্রিকাকে বলেন, পাসপোর্ট ব্লক মূলত সরকারি সিদ্ধান্তের বিষয়। সরকার নির্দেশনা দিলে স্পেশাল ব্রাঞ্চ (পুলিশের বিশেষ শাখা) আবেদন করে ইমিগ্রেশন বিভাগের কাছে। এরপর পাসপোর্ট ব্লক হয়। সরোয়ার হোসেন বাবলার পাসপোর্ট ব্লকের বিষয়ে কোনো তথ্য আমাদের কাছে থাকার কথা নয়।’
বুধবার (৫ নভেম্বর) মাগরিবের নামাজের পরপরই চট্টগ্রামে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে নির্বাচনী গণসংযোগে অংশ নিয়ে গুলিতে নিহত হন সরোয়ার হোসেন বাবলা। এ সময় চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহও গুলিবিদ্ধ হন। এরশাদ উল্লাহ বর্তমানে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পুলিশ জানায়, চট্টগ্রাম নগর পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সরোয়ার বাবলা। ৫ আগস্টের পর জামিনে মুক্তি পান। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজিসহ ১৫টির বেশি মামলা রয়েছে।
এদিকে সরোয়ার হত্যায় করা মামলার এজাহারে এক নম্বরে যাঁর নাম এসেছে, সেই সাজ্জাদ আলী ওরফে বড় সাজ্জাদের। নগরের বায়েজিদ বোস্তামীর চালিতাতলী এলাকার ঠিকাদার আবদুল গণির ছেলে সাজ্জাদ আলী। ১৯৯৯ সালের ২ জুন পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর লিয়াকত আলী খান বাড়ির সামনে খুন হন। লিয়াকত হত্যায় সাজ্জাদ জড়িত ছিলেন বলে ব্যাপক প্রচার আছে। এ নিয়ে দায়ের করা মামলার আসামি ছিলেন সাজ্জাদ আলী। লিয়াকত হত্যার পর অপরাধজগতে সাজ্জাদের নাম ছড়িয়ে পড়ে।
২০০০ সালের ১২ জুলাই মাইক্রোবাসে করে একটি দলীয় সমাবেশে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন ছাত্রলীগের ছয় নেতা-কর্মী। পথে বহদ্দারহাটে ওই মাইক্রোবাস থামিয়ে ব্রাশফায়ার করে সন্ত্রাসীরা। ঘটনাস্থলেই ছাত্রলীগের ওই ছয় নেতা-কর্মীসহ আটজন মারা যান। ‘এইট মার্ডার’ নামে পরিচিত ওই হত্যাকাণ্ডে সাজ্জাদ নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ ওঠে। ২০০০ সালের ১ অক্টোবর একে-৪৭ রাইফেলসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বড় সাজ্জাদ। ২০০৪ সালে জামিনে বেরিয়ে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। বর্তমানে ভারতের পাঞ্জাবে রয়েছেন বলে জানা গেছে। বড় সাজ্জাদের স্ত্রী পাঞ্জাবি হওয়ার সূত্রে তিনি পাঞ্জাবে অবস্থানের সুযোগ পেয়েছেন।