ইউক্রেন যুদ্ধে বেশ দীর্ঘস্থায়ী এবং ধারণার চেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হলেও অগ্রগতির মুখ দেখেছে রাশিয়া। এরই মধ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষিত অন্যতম লক্ষ্য—লুহানস্ক প্রদেশকে ইউক্রেনের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই শান্তি চুক্তি না হলে আগামী দু-এক মাসের মধ্যেই পার্শ্ববর্তী দনেৎস্কও রাশিয়া এবং তাদের মিত্রদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আলোচনা করার কোনো মানেই হয় না। কারণ, রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি এবং অনেক ক্ষেত্রে হয়তো বেশিও। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার না হারার কারণ এটি নয়। রাশিয়ার বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পরামর্শদাতা সের্গেই কারাগানভের মতে, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ দেশটির ‘অস্তিত্বের’ প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত।
কারাগানভ বলেন, এই যুদ্ধের বিষয়ে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—রাশিয়া অন্যতম বিশ্বশক্তি। বিশ্বে সে তার মতো প্রভাব বলয় তৈরি করতে চায়। এ যুদ্ধে রাশিয়া হারলে রাশিয়ার ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। তাই রাশিয়া কোনোভাবেই হার মেনে নেবে না। এটা পশ্চিমাদের বুঝতে হবে।
এই সংঘাত অধিকাংশ পশ্চিমা অভিজাতের জন্য এক অস্তিত্বের লড়াই উল্লেখ করে কারাগানভ নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, এর পেছনে তাদের ব্যর্থতা আছে। আছে গণমানুষের দিক থেকে তাদের অনাস্থার বাস্তবতাও। তাই জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে নিয়ে যেতে তাদের দরকার ছিল একটি শত্রুর। এবং সেই শত্রুই হলো রাশিয়া। কিন্তু ১৯৮০-এর দশকে উদারবাদী বিশ্বায়নের নামে জারি করা সাম্রাজ্যবাদী কাঠামো ধসে গেলে শুধু বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা অভিজাতরাই নয়, অধিকাংশ পশ্চিমা দেশই আর টিকে থাকার ক্ষমতা রাখে না। তাই এই যুদ্ধ কোনোভাবেই শুধু ইউক্রেনের বিষয় নয়। বরং ইউক্রেন ও তার জনগণকে পশ্চিমা অভিজাতরা নিজেদের শৌর্যকে অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে কামানের গোলা হিসেবে ব্যবহার করছে।
বিপরীতে রাশিয়ার কাছে এই যুদ্ধ কেবল তার অভিজাত গোষ্ঠীকে রক্ষা নয়, বরং দেশটির অস্তিত্বের জন্যই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই এই যুদ্ধে রাশিয়ার কোনোভাবেই হারা চলবে না বলে মনে করেন কারাগানভ। তাঁর মতে, এ কারণেই খুব বেশি সহিংসতার আশ্রয় না নিয়েও রাশিয়া জিতবে বলে আশা করা যায়। যদিও মানুষ কিন্তু মরছে।
এই যুদ্ধ ও ক্ষয়ের জন্য এক ধরনের পীড়নও বোধ করেন কারাগানভ। তিনি বলেন, ‘গত ২৫ বছর ধরে এমন একটি যুদ্ধের শঙ্কা ছিল আমার মধ্যে। আমি এটি থামাতে পারিনি। এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা।’
কিন্তু কারাগানভ যে কথা বলছেন, তার সমালোচনাও আছে। তিনি এই যুদ্ধকে পশ্চিমাদের ‘রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন’ করার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো হিসেবে বর্ণনা করলেও, পশ্চিমা দেশগুলোর বিশ্লেষকেরা একে দেখছেন ভিন্নভাবে। তাঁরা বলছেন, এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই রাশিয়া বরং বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। এই যুদ্ধকে সামনে রেখে, ইউক্রেনে চলা ধ্বংসযজ্ঞকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো বরং নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করছে। সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগ দিচ্ছে। এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পশ্চিম রাশিয়াকে আগামী বহু বছর ‘বড় হুমকি’ হিসেবে বিবেচনা করবে।
কিন্তু এই যুদ্ধের কারণে রাশিয়া এরই মধ্যে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছে বলে মন্তব্য করেন সার্জ শ্মেম্যান। উদাহরণ হিসেবে তিনি রাশিয়া থেকে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়া, খেলা বা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের তারকাদের এই যুদ্ধের কারণে ভোগান্তিতে পড়া ইত্যাদির কথা তুলে ধরেন তিনি। একই সঙ্গে রাশিয়ার ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে ভ্লাদিমির পুতিন ধ্বংস করছেন বলে একটি মত চাউর হয়েছে উল্লেখ করে কারাগানভ কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি এসব ঘটনাকে রাশিয়ার জন্য ভালো কিছু বলে বিবেচনা করছেন কি-না, করলে কেন?
জবাবে কারাগানভ যা বলেছেন, তাতে ভবিষ্যতের বৈশ্বিক কাঠামোয় প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করার আকাঙ্ক্ষাই প্রবল হয়ে উঠেছে। তাঁর মতে, একটা ন্যায্য ও স্থিতিশীল বিশ্বকাঠামোয় নিজের শক্ত অবস্থান তৈরির লড়াই এটি। এ যুদ্ধ রাশিয়ার কাছে উন্নত ও গৌরবময় সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য লড়াই। তিনি বলেন, ‘এমন একটা যুদ্ধ কিছু না হারিয়ে জয় করা সম্ভব নয়। তবে এর কারণে কয়েক লাখ তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের রাশিয়া ছেড়ে যাওয়াটা দুঃখজনক। যদিও আমি জানি, আপনিও একমত হবেন যে, তারা সুখে নেই। তাদের কেউ কেউ ফিরে আসবে আশা করি। রুশ সংস্কৃতি বা রাশিয়ার যেকোনো কিছুকে খারিজ করাটা পশ্চিমাদের সমস্যা। এটা অনেকটা তাদের নিজের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও খ্রিষ্টীয় নৈতিকতাকে খারিজ করার মতোই।’
মোদ্দা কথা, কারাগানভ নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে পশ্চিমাদের খারিজ করার সংস্কৃতিকে এই সংকটের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর মতে, এই যুদ্ধের কারণে সাধারণ রুশদের কষ্ট হচ্ছে। পশ্চিমারা একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়ায় একটা বিদ্রোহের আবহ তৈরি করতে চায়। কিন্তু এসব করে উল্টো ফল হচ্ছে বলে দাবি কারাগানভের। তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে একটা লাভ হয়েছে যে, রাশিয়ায় পশ্চিমা মূল্যবোধ নিয়ে থাকা লোকেরা অন্য দেশে চলে গেছে। এতে পশ্চিমাবান্ধব উপাদান থেকে মুক্ত হচ্ছে রাশিয়া। তবে, এর মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় সংস্কৃতি বিতাড়ন রাশিয়ার উদ্দেশ্য নয়। বরং এর ফলে ভবিষ্যতে রাশিয়াই হয়ে উঠবে অন্যতম অঞ্চল, যেখানে ইউরোপের সংস্কৃতি ও এর যাবতীয় সম্পদ ও মূল্যবোধের দেখা মিলবে।
রাশিয়া বারবার করে এ যুদ্ধে জয়ের কথা বলছে নিজের অস্তিত্ব টেকানোর প্রশ্নে। কিন্তু এই জয় আসলে কীসে নির্ধারিত হবে জানতে চাইলে সের্গেই কারাগানভ বলেন, ‘লক্ষ্যটা আদতে পরিবর্তনশীল। তবে ন্যূনতম লক্ষ্য হচ্ছে, দনবাসকে কিয়েভের ক্ষমতাকাঠামো থেকে মুক্ত করা। এটি এখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তারপরই আসছে ইউক্রেনের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল মুক্ত করার প্রশ্ন। আর তার পর রাশিয়ার লক্ষ্য হয়তো থাকবে, কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোর নিরস্ত্রীকরণ।’
কারাগানভ বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ পশ্চিম আরোপিত বিশ্ব ব্যবস্থা পতনের মধ্য দিয়ে একটি ন্যায্য ও মুক্ত বহুমেরু বিশ্ব ব্যবস্থার দিকে যাত্রার ছোট্ট একটি পদক্ষেপ। সেই বিশ্ব ব্যবস্থার অন্যতম কেন্দ্র হবে ইউরেশিয়া, যেখানে রয়েছে মহান সভ্যতার ইতিহাস, যাকে শত শত বছর ধরে অবদমনে বাধ্য করা হয়েছে। এখানে রাশিয়া বিশ্ব সভ্যতাগুলো মধ্যে সংযোগ সাধনের এক নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই কাঠামোয় ভারসাম্য রক্ষার কাজটি রাশিয়া করতে পারে। দুটি ভূমিকাই রাশিয়া পালন করতে পারবে বলে আশা করা যায়।