ক্রমেই বিশ্বরাজনীতির খেলার মাঠ হয়ে উঠেছে পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ এর মিত্রদেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যকার চলমান দ্বৈরথ ক্রমশ ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’-এর দিকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় পূর্ব ইউরোপের সদস্যদেশগুলোয় ন্যাটোর সেনা পাঠানো এবং দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন বিমানবাহী রণতরি বহরের উপস্থিতি আসলে কী ইঙ্গিত দেয়?
চলতি সপ্তাহের প্রথমার্ধে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে চলমান উত্তেজনা নিরসনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের মধ্যকার বৈঠক কোনো ধরনের ফলাফল ছাড়াই শেষ হয়েছে। এর পরপরই ইউক্রেন থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য তাদের দূতাবাসের কর্মিসংখ্যা কমিয়ে ফেলেছে। এই কমিয়ে ফেলার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই ন্যাটোর পক্ষ থেকে পূর্ব ইউরোপে সেনা জমায়েত বাড়ানোর ঘোষণা আসে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ন্যাটোর মহাসচিব জেমস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ‘ন্যাটোতে সদস্যদেশগুলোর অতিরিক্ত সেনা পাঠানোকে স্বাগত জানাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘জোটভুক্ত প্রত্যেক সদস্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে থাকবে ন্যাটো। প্রয়োজনে পূর্ব ইউরোপে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করে হলেও এই প্রক্রিয়া বহাল থাকবে।’
বিশ্লেষকদের মতে, কিয়েভ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের দূতাবাসকর্মী প্রত্যাহার এবং পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন ইউক্রেন ঘিরে একটি প্রবল সংঘাতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কিংবা রাশিয়া—কোনো পক্ষই কি চাইবে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে? কারণ, সমরক্ষেত্রে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র মুখোমুখি হওয়া মানেই একটি সম্ভাব্য পরমাণুযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা সৃষ্টি হওয়া। আবার নিকট ও সুদূর অতীতে এ দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করলেও কখনোই দুই পক্ষ সরাসরি কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি। এখনো জড়াবে না বলেই প্রত্যাশা করছেন জার্মান নৌবাহিনীর সদ্য সাবেক প্রধান কেই আচিম শোয়েনবাখ। তিনি বলেছেন, ‘ক্রিমিয়া আর কখনোই ইউক্রেনে ফিরবে না। ইউক্রেন আক্রমণ করতে চায় রাশিয়া—এটি ভুল ধারণা; বরং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন প্রকৃতপক্ষে সম্মান চেয়েছেন।’
তবে বেশির ভাগ বিশ্লেষক মনে করেন, ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রুশ-মার্কিন সরাসরি যুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা কম। হয়তো শিগ্গিরই এই সংকটের রাজনৈতিক সমাধান দেখা যাবে। কিন্তু দুই পক্ষের মধ্যকার এই টানাপোড়েন সরলভাবে পাঠের কোনো সুযোগ নেই। কেননা, এর সঙ্গে বিশ্বমঞ্চে মোড়লগিরি করার হিসাব জড়িত। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র একটু বেকায়দায় আছে বলেই বোধ হচ্ছে। যেকোনো সমরবিদ এক বাক্যে স্বীকার করে নেবেন যে, দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ কখনো সুবিধার নয়। অথচ মার্কিন সরকারকে তা-ই করতে হচ্ছে। সিএনএনের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রকে যেমন ইউক্রেন সংকটে নাক গলাতে হচ্ছে, একই সঙ্গে বিশ্বের উদীয়মান অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ন্যাটোকে দিয়ে ইউরোপ ফ্রন্ট সামলানোর চেষ্টা করা গেলেও এশিয়ায় নিজেকেই সব করতে হচ্ছে। কারণ, এশিয়ায় গঠিত মার্কিন ‘সহমর্মী’ জোট কোয়াড এখনো প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে কোয়াডের অন্য তিন সদস্য জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে সেভাবে সমর্থন করতে পারছে না। ফলে ‘প্রক্সি ওয়ার’ চালানো যে সম্ভব হচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্র এখন দক্ষিণ চীন সাগরে মিত্রদেশ জাপানের সঙ্গে সামরিক মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। তবে এই মহড়া যে স্রেফ চীনকে দেখানোর জন্যই, তা বুঝতে গণক হওয়ার প্রয়োজন নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই মহড়ার আরও একটি উদ্দেশ্য হতে পারে চীনকে নিজের এলাকায় ব্যতিব্যস্ত রাখা, যাতে করে রুশ-চীনা জোটবদ্ধতা সম্ভব না হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের জবাব এরই মধ্যে চীন দিয়েছে। দেশটি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র তাইওয়ানের আকাশসীমায় ৩৯টি যুদ্ধবিমান উড়িয়েছে। আর এতে করে দুই ফ্রন্টের লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যস্ততা আরও বেড়েছে বৈ কমেনি।
রাশিয়া অবশ্য শুরু থেকেই বলে চলেছে, ইউক্রেন আক্রমণের কোনো পরিকল্পনা দেশটির নেই। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো আশঙ্কা জানাচ্ছে ক্রমাগত। বিশ্লেষকদের মতে, এদিক থেকে ভ্লাদিমির পুতিন বেশ সফল। কারণ, তিনি দাবি করতেই পারবেন যে, পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে ভয় পেয়েছে! আর সে ধরনের প্রচারণা তাঁকে নিজের দেশের জনগণের কাছে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে পারে।
সব মিলিয়ে বলাই যায়, একমাত্র পরাশক্তি হওয়ার লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবার কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে। রাশিয়া ও চীন—দুই ফ্রন্টেই সামরিক উপস্থিতিও জোরদার করেছে মার্কিনরা। কোন পক্ষের গলায় জয়ের মালা জড়ায়, তা-ই এখন দেখার!
বিশ্লেষণ সম্পর্কিত আরও পড়ুন: