বেশ কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছিল, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে আক্রমণ করবেন। কিন্তু করেননি। শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আক্রমণ করেই বসলেন। কিন্তু কেন, সেই প্রশ্ন উত্তর খুঁজছেন বিশ্লেষকেরা।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মস্কো সব সময়ই ইউক্রেনে আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছে। পুতিন বিভিন্ন সময়ে তাঁর বক্তৃতা ও লেখায় ‘ইউক্রেন কেন দখল করা উচিত’ সে বিষয়ে যুক্তিও দেখিয়েছেন। সেই সব যুক্তির নিরিখে ২০১৪ সালে তিনি ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করেন। তারপর ক্রমশ ইউক্রেনের বেশিরভাগ অঞ্চল কেন দখলের চেষ্টা করেননি তিনি?
গত শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের এক বছর পূর্তি হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তির আলোচনায় এই প্রশ্নগুলো সামনে চলে এসেছে।
২০১৪ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। তিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও ‘রুশপন্থী’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর সময়ে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীও দুর্বল ছিল। তখন ইউক্রেনের বেশিরভাগ এলাকা দখল করা রুশদের জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। তারপরও পুতিন কেন ইউক্রেন আক্রমণ না করে বছরের পর বছর কালক্ষেপণ করেছেন, তা নিয়ে রাশিয়ার কট্টরপন্থীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। তাঁরা এ নিয়ে পুতিনের সমালোচনাও করেছেন।
সেই সময়ে পুতিনের সংযমের কারণ ছিল ৯০ দশকের রুশ কৌশলের অংশ। কৌশলটি ছিল এমন—ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করা, পাশাপাশি ইউরোপজুড়ে রাশিয়ার নিরাপত্তাব্যবস্থা তৈরি করা। এটি ছিল মিখাইল গর্বাচেভের কৌশল। তিনি পশ্চিমকে ইউরোপে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
পুতিনও একসময় এই ধারণাই অন্তরে লালন করতেন। তিনি ২০১২ সালে লিখেছিলেন, ‘রাশিয়া বৃহত্তর ইউরোপের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এমনকি ইউরোপীয় সভ্যতার বৃহত্তর অংশই হচ্ছে রাশিয়া। আমাদের নাগরিকেরা নিজেদের ইউরোপীয় বলেই মনে করে।’
কিন্তু পুতিন এখন সেই ধারণা থেকে বের হয়ে এসেছেন। তিনি এখন ‘ইউরেশিয়ান সভ্যতা’ ধারণাটি লালন করেন।
১৯৯৯ সালে রাশিয়ার মসনদে বসেন পুতিন। আর ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মসনদে বসেন জো বাইডেন। মাঝের এই দীর্ঘ সময়ে রাশিয়ার সেই ৯০ দশকের কৌশলটি ক্রমশ গুরুত্ব হারিয়েছে। তবে প্যারিস ও বার্লিনের মধ্যে এখনো ধারণাটি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে।
২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট ছিলেন দিমিত্রি মেদভেদেভ। সেই সময় তিনি একটি নিরাপত্তা চুক্তির প্রস্তাব করেছিলেন, যাতে ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঠেকানো যায়। ইউক্রেন যাতে নিরপেক্ষ থাকে, সেই চেষ্টাও ছিল ওই প্রস্তাবে। কিন্তু পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো প্রস্তাবটিকে খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি।
২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন। তখন ইউরোপ-আমেরিকার বিভক্তিকরণের রুশ স্বপ্ন পুনরুজ্জীবিত হয়। কোনো নির্দিষ্ট নীতির কারণে নয়, বরং ইউরোপের সঙ্গে ট্রাম্পের তীব্র শত্রুতার জন্যই রাশিয়া আশাবাদী হয়ে ওঠে। কিন্তু জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর ইউরোপ-আমেরিকা আবার একত্রিত হয়েছে। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেন আর দনবাসকে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাইছে না। এমনকি ২০২১ সালে ‘দনবাস পুনরুদ্ধার করা হবে’ বলে হুমকিও দিয়েছিল ইউক্রেন।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ২০১৫ সালে জার্মানির অ্যাঙ্গেলা মের্কেল ও ফ্রান্সের ফ্রাঁসোয়া ওলাদের মধ্যস্থতায় যে মিনস্ক-২ চুক্তি হয়েছিল, তা ছিল ইউক্রেনকে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে সময় দেওয়ার একটি কৌশলমাত্র। ২০২২ সালে এসে পুতিন সম্ভবত সেই ফাঁকিটুকু ধরতে পেরেছেন। তাই ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন চালাতে আর দ্বিধা করেননি।
তবে আগ্রাসন শুরুর আগে ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ থাকার (ন্যাটোতে যোগ না দেওয়া) চুক্তি করতে ও দনবাসের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর মাধ্যমে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে চাপ দিয়েছিলেন পুতিন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর সেই ‘চাপদান প্রকল্প’ ব্যর্থ হয়েছে।
এই সবকিছু মিলিয়ে পুতিন ইউক্রেনে আক্রমণ চালিয়েছেন। এই যুদ্ধ কত দিন চলবে, তা বলা মুশকিল। এটা বলা আরও মুশকিল যে, এই যুদ্ধে রাশিয়া জিতবে কি না। কারণ এখন পর্যন্ত সে ধরনের সুস্পষ্ট লক্ষণ নেই। ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে, সেই স্বপ্নও মোটামুটি দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। এর জন্য পুতিন একাই দায়ী কি না, সেটিও ভেবে দেখার সময় এসেছে।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মারুফ ইসলাম