মহিলা দাবায় একক রাজত্ব করছেন তিনি। এবার নিয়ে টানা তৃতীয়বার জিতলেন জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করলেও দাবাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। সাদা-কালো বোর্ডে দাপট দেখিয়ে চেষ্টা করছেন নিজেকে রঙিনভাবে ফুটিয়ে তোলার। লক্ষ্য এখন গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার। এর আগে পেরোতে হবে আন্তর্জাতিক মাস্টারের পথ। সেসব নিয়ে গতকাল আজকের পত্রিকার সঙ্গে কথা বলেছেন ২১ বছর বয়সী ফিদেমাস্টার নোশিন আনজুম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনোয়ার সোহাগ—
প্রশ্ন: জাতীয় দাবায় হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হলেন, তিন শিরোপার মধ্যে কোনটি এগিয়ে রাখবেন?
নোশিন আনজুম: প্রথমবার। আসলে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনুভূতিটা স্পেশাল, ওটা কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যায় না। তবে এবারেরটা কঠিন ছিল। ১২ খেলোয়াড়ের মধ্যে ৯ জনই তরুণ ছিল এবং সবার রেটিং প্রায় কাছাকাছি। তো এমন একটা অবস্থা ছিল, যে কেউ যে কারোর সঙ্গে হারতে পারে। তাই আমার মনে হয়েছিল যে এবার একটু কঠিন ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যেহেতু সামনে অলিম্পিয়াড আছে, সুতরাং জেতাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল আসলে।
প্রশ্ন: আপনার খেলায় সিসিলিয়ান ডিফেন্স কৌশলের ছাপ দেখা যায়?
নোশিন: আসলে সিসিলিয়ান কৌশলে আমি এই টুর্নামেন্টে প্রথম খেলেছি। দাবার ১০ বছরের ক্যারিয়ারে আমি রুই লোপেজ কৌশলে খেলেছি। সিসিলিয়ান কৌশলে শুরু করেছি, দেখা যাক সামনে কেমন করি। সিসিলিয়ান দেখতে ভালো লাগে আরকি। কিন্তু আমি ওই রকম ভালো খেলিনি কখনো। আমি আসলে ভার্সেটাইল খেলোয়াড়।
প্রশ্ন: আপনি অনেকটা সময় নেন, তারপরই আক্রমণাত্মক খেলতে পছন্দ করেন...
নোশিন: হ্যাঁ, শুরুতে আক্রমণাত্মক থাকলে সেটা অনেক সময় বিফলে যায়। আগে নিজের পজিশন বুঝে নিতে হয় এবং আক্রমণের সুযোগ থাকলে তখন আক্রমণে যাওয়া উচিত। না হলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে।
প্রশ্ন: আপনার খেলার ধরনে ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন আছে কি না?
নোশিন: মানুষ বলে যে আমি শান্তশিষ্ট। তো খেলার বোর্ডে আমি এ রকমই থাকার চেষ্টা করি। খেলোয়াড়েরা বলেছে যে আমি বোর্ডে এত কুল থাকি কীভাবে? আসলে ভেতরে ভেতরে কিন্তু অনেক নার্ভাস থাকি, সেটা দেখাই না আরকি।
প্রশ্ন: নার্ভাসনেসটা কীভাবে সামলান?
নোশিন: আমি খেলার দুই-এক দিন আগে থেকে মানে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকার চেষ্টা করি। নিজেকে নিজে কথা বলা। মোটিভেট করা। কিছু বিশেষ বিষয় খেলার আগে মাথায় রাখা। খেলার মাঝখানে হাঁটাহাঁটি করা। চা-কফি খাওয়া। এগুলোর ফলে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। মেডিটেশনও হেল্প করে অনেকটা।
প্রশ্ন: ওয়ালিজার বিপক্ষে সপ্তম রাউন্ডে কালো ঘুঁটি ছিল আপনার। ৮৯ চালের পর জেতার অনুভূতিটা কেমন ছিল?
নোশিন: ম্যাচে জেতার সুবাস আমি পাই অনেক আগেই। কিন্তু তা কনভার্ট করা অতটা সহজ ছিল না। কাপাব্লাঙ্কা গেম আমাকে এখানে সহায়তা করেছে। কালো ঘুঁটি নিয়ে বিশেষ করে জেতাটা কঠিন। এটা অন্যতম কঠিন রাউন্ড ছিল আমার জন্য।
প্রশ্ন: গুকেশ দোম্মারাজু বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ায় উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন, ফেসবুকে দেখলাম। তাঁকেই কি আদর্শ মানেন?
নোশিন: তাঁর গেম সেন্সটা নিজের মধ্যে আনার চেষ্টা করি। আমার আসলে বর্তমান খেলোয়াড়দের থেকে পুরোনো খেলোয়াড়দেরই ভালো লাগে বেশি। তাঁদের খেলা ফলো করি, বই পড়ি। বিশেষ করে কাপাব্লাঙ্কা (সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন) গেম আমার প্রিয়। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের মধ্যেও আমি তাঁর বই পড়েছি। তিনি তো এন্ডগেমের মাস্টার ছিলেন। আমার পক্ষে তো মাস্টার হওয়া সম্ভব না, কিন্তু তাঁর মতো সরলতা রাখার চেষ্টা করতাম।
প্রশ্ন: ‘কুইনস গ্যাম্বিট’ ওয়েব সিরিজটা নিশ্চয় দেখেছেন। সেখানে নিজের মধ্যে কি কোনো মিল খুঁজে পান?
নোশিন: অনেক প্রেরণাদায়ক একটা সিরিজ আসলে। কয়েক দিন আগেও আবার দেখেছি নিজেকে মোটিভেট করার জন্য। নারী খেলোয়াড়দের অনেকে অবহেলা করে। আসলে ছেলেরা ভাবে যে আমরা তাদের সঙ্গে পারবই না। কুইনস গ্যাম্বিটে যেটা দেখায়, মেয়ে হয়েও সে ওপেন লেভেলে যেভাবে লড়াই করে এবং তো ওইটা অনেক প্রেরণাদায়ক আমার কাছে। আমিও চাই ওপেন লেভেলে এ রকম লড়াই করতে, রেটিং বাড়াতে চাই।
প্রশ্ন: মেয়েরা কোথায় পিছিয়ে আছে?
নোশিন: আমাদের দেশে এমনিতে নারী খেলোয়াড় কম। ওপেন টুর্নামেন্ট হলে আসলে মেয়েরা অংশগ্রহণ করে না। ৪০ ছেলের মধ্যে হয়তো ৫ নারী খেলোয়াড় থাকে। তো মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। আমাদের ফেডারেশনের ভেন্যুটা ছোট। ছোট জায়গায় আসলে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের খেলা একটু অস্বস্তিকর হতে পারে।
প্রশ্ন: প্রতিপক্ষের খেলা বোঝার জন্য আপনি কোন জিনিসগুলোর ওপর সবচেয়ে বেশি নজর দেন?
নোশিন: খেলার আগে ওই প্রতিপক্ষের গেমগুলো ভালোভাবে ফলো করি। সে অ্যাটাকিং নাকি পজিশনাল খেলোয়াড়, সে কী ধরনের ভুল করে থাকে; সেসব মাথায় রেখে খেলার চেষ্টা করি।
প্রশ্ন: আপনার জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত কোনটা ছিল? যেটা পেরিয়ে আজকের নোশিন হয়ে উঠলেন?
নোশিন: প্রথমবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা। কারণ সেবার আমি খুব অসুস্থ ছিলাম। কোয়ালিফাই করাটা আমার কাছে অনেক কঠিন ছিল। সেবার চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা আসলে প্রত্যাশার বাইরে ছিল। আর সেটাও চ্যাম্পিয়ন হয়েও গেলাম।
প্রশ্ন: আপনি এখনো আন্তর্জাতিক মাস্টার হতে পারেননি, বিষয়টা কতটুকু হতাশার?
নোশিন: হতাশার তো অবশ্যই। কারণ যেমনটা উন্নতি করার দরকার ছিল, সেটা করতে পারিনি। আক্ষেপ তো লাগেই। আশা করি শিগগির পারব। নিজেকে ৫-৬ বছরের মধ্যে গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে দেখতে চাই।
প্রশ্ন: মহিলা দাবাড়ুদের ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?
নোশিন: আসলে দাবা খ্যাতি লাভ না করলে দেশে ভবিষ্যৎ নেই বলতে গেলে। কারণ গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পরও এখানে সেসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না, যা অন্য দেশে দেওয়া হয়। দুই-তিন বছর আগেও দাবায় একটা গ্ল্যামার ছিল।
প্রশ্ন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আপনি। দাবায় তা কীভাবে কাজে লাগে আপনার?
নোশিন: আসলে নিজের ইচ্ছাতেই আমি এই বিষয়ে পড়ছি। দাবায় তো আমাদের ফিটনেসের ব্যাপার আছে। খাবারদাবার মেইনটেইন করা, কী কী খাব আর কী কী খাব না। এগুলো নিজের মধ্যে জানা থাকে। তাই খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াটা আমার জন্য বেশ সহায়ক।