খালেদা জিয়ার জানাজা ও দাফন
যত দূর চোখ যায়, শুধু মানুষ আর মানুষ। দল-মত ও পথের ভেদাভেদ ভুলে সবাই এসে জড়ো হয়েছে এক জায়গায়। চোখের জল, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার ঢেউ বয়ে গেছে অগুনতি মানুষের সেই জনসমুদ্রে।
তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শেষবিদায়ের ক্ষণে গতকাল বুধবার এমনই জনসমুদ্রে রূপ নিয়েছিল রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সংসদ ভবনের চারপাশ ও সংলগ্ন এলাকায়। মানুষের ভালোবাসার সেই সমুদ্রকে সঙ্গী করে বিদায় নিলেন খালেদা জিয়া।
সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা ও সংলগ্ন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আয়োজন করা হয়েছিল জানাজার। কিন্তু সেখান থেকে মানুষের সমুদ্র যেন নদীর মতো ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের রাস্তা ধরে। সংসদ ভবন থেকে জানাজায় দাঁড়ানো মানুষের সারি লম্বা হয় দেড়-দুই কিলোমিটার পর্যন্ত।
জানাজা হয় বেলা ৩টার দিকে। এরপর সেখান থেকে মরদেহবাহী গাড়ির বহর ধীরে ধীরে গিয়ে থামে সংসদ ভবনসংলগ্ন জিয়া উদ্যানের কাছে। সন্ধ্যার আগে সেখানে স্বামীর কবরের পাশে শায়িত করা হয় খালেদা জিয়াকে। চোখের জলে প্রিয়জনকে শেষবিদায় জানান পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা। বিএনপির নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ বিদায় জানান তাঁদের আপসহীন নেত্রীকে। সবার প্রার্থনায় ছিল মরহুমার রুহের মাগফিরাত কামনা।
গত মঙ্গলবার সকাল ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান খালেদা জিয়া। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীসহ সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির যৌথ সভায় খালেদা জিয়ার জানাজা ও দাফনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
খালেদা জিয়ার জানাজা ও দাফনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গতকাল ভোর থেকেই মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও এর আশপাশের এলাকায় জড়ো হতে থাকে মানুষ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়। দল-মতনির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দিন শেষে বিএনপির চেয়ারপারসনের শেষবিদায়ের এই অনুষ্ঠান সর্বজনীন এক জমায়েতে পরিণত হয়। রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকা ছাড়াও দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসে মানুষ। প্রবল আবেগ আর ভালোবাসাকে সঙ্গী করে আসা মানুষগুলোর চোখে ছিল জল।
সংসদ ভবনসংলগ্ন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর পশ্চিম প্রান্তে তৈরি করা হয় জানাজা মঞ্চ। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনের তিনটি মাঠের অধিকাংশ জায়গায় মানুষ অবস্থান নেন। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ছাড়িয়ে ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বিজয় সরণিতে দাঁড়িয়ে মানুষ জানাজায় অংশ নেয়। অন্যদিকে ধানমন্ডি ২৭, ধানমন্ডি ৩২ ছাড়িয়ে রাসেল স্কয়ারের দিকেও জানাজার লাইনে দাঁড়িয়ে যায় মানুষ।
দলের চেয়ারপারসনের শেষবিদায়ে উপস্থিত থাকতে মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজধানীতে আসতে শুরু করেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। জানাজায় অংশ নিতে মঙ্গলবার রাতেই ঢাকায় আসেন বগুড়ার কৃষক সাত্তার মিয়া। ঢাকায় থাকার জায়গা না পেয়ে তিনি রাস্তায় নির্ঘুম রাত কাটান। গতকাল গণমাধ্যমকে তিনি বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায় ‘ম্যাডাম হামাগের (আমাদের) মা। ওনাক (ওনাকে) শেষবারের মতো দেখমু (দেখব) না, তা কি হবি (হবে)? শরীর চলিচ্ছে (চলছে) না, তা-ও মনের জোরে আচ্ছি (আসছি)। ওরার (ওনার) জানাজায় শরিক হতে পারলেই শান্তি হামাকের (আমাদের)।’
পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী আবদুল লতিফ বলেন, ‘১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জানাজা দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, বাংলাদেশে আর হয়তো এমন দৃশ্য দেখব না। আজ ৪৪ বছর পর তাঁর স্ত্রীর জানাজায় এসে মনে হচ্ছে, ইতিহাস আবার ফিরে এসেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এমন ভালোবাসা জোর করে আদায় করা যায় না। এটা আল্লাহ প্রদত্ত বিষয়। তিনি যাকে সম্মান দেন, কেউ তাকে অসম্মান করতে পারে না।’
দুপুর ১২টার দিকে খালেদা জিয়ার মরদেহ আনা হয় জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায়। জানাজাস্থলে আসা মানুষের সহায়তার জন্য মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের অনেক স্থানে বড় বড় স্ক্রিন বসানো হয়। মাইকে পরিবেশন করা হতে থাকে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার জীবনীর ওপর নির্মিত তথ্যচিত্রও কিছুক্ষণ পরপর দেখানো হয়। যেখানে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব, ১৯৯১ সালে সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রের জন্য নেওয়া পদক্ষেপ, ফ্যাসিবাদ আমলে রাজনৈতিক দৃঢ়তা সর্বশেষ আধিপত্যবাদ বিরোধিতায় খালেদা জিয়ার শক্ত অবস্থানের কথা তুলে ধরা হয়।
দুপুরের দিকে জানাজাস্থলে আসতে শুরু করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারের উপদেষ্টা, তিন বাহিনীর প্রধানেরাসহ দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। বেলা আড়াইটার দিকে জানাজাস্থলে আসেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর কিছুক্ষণ পরে আসেন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা তাঁকে সান্ত্বনা দেন। জানাজায় প্রধান উপদেষ্টার পাশেই দাঁড়ান তিনি।
বেলা আড়াইটার পরে সংসদ ভবন এলাকা থেকে খালেদা জিয়ার মরদেহবাহী গাড়ি জানাজাস্থলের উদ্দেশে রওনা দেয়। মানুষের ভিড় ঠেলে কয়েক শ মিটারের পথ আসতে ২০ মিনিটের বেশি সময় লেগে যায়। বেলা ২টা ৫০ মিনিটের পরে জানাজাস্থলের কাছে পৌঁছায় গাড়িটি। পরে খালেদা জিয়ার কফিন এনে রাখা হয় মঞ্চে। জানাজাপূর্ব সংক্ষিপ্ত আলোচনায় খালেদা জিয়ার জীবনী নিয়ে বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
পরে পরিবার ও দলের পক্ষে বক্তব্য দেন খালেদা জিয়ার ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি মায়ের জন্য সবার কাছে দোয়া চান। তারেক রহমান বলেন, ‘আমি উপস্থিত সকল ভাই-বোনদের বলছি, মরহুমা বেগম খালেদা জিয়া যদি কারও কাছ থেকে কোনো ঋণ নিয়ে থাকেন, তাহলে আমাকে জানাবেন, আমি তা পরিশোধ করব। জীবিত থাকতে ওনার কথায় কেউ আঘাত পেয়ে থাকলে আমি তাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আল্লাহ তাঁকে বেহেশত দান করুন।’
২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজার পরে খালেদা জিয়াকে রাখা হয় পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে। একটি বিশাল পরিত্যক্ত কারাগারে তিনি ছিলেন একমাত্র বন্দী। সেখানে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে তাঁর স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটে। পরে তাঁকে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। করোনা মহামারির সময়ে সাজা স্থগিত রেখে বাসায় থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সেটাতে কর্ণপাত করেনি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে দলটি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে মুক্ত খালেদা জিয়া গত বছরে লন্ডনে চিকিৎসা নেন।
জানাজায় আগত বিএনপি নেতারা আওয়ামী লীগ আমলে খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা না পাওয়ার বিষয়টি সোচ্চার ছিলেন। খালেদা জিয়াকে চিকিৎসা নিতে না দিয়ে ‘হত্যা করা হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। এ হত্যার দায় থেকে সাবেক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কখনোই মুক্তি পাবেন না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বেলা তিনটায় শুরু হয় জানাজার আনুষ্ঠানিকতা। ইমামতি করেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আবদুল মালেক। বেলা ৩টা ৫ মিনিটের দিকে জানাজা শেষে খালেদা জিয়ার মরদেহ কাঁধে তুলে নেন তারেক রহমান। এ সময় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক ও ইসলামি বক্তা মিজানুর রহমান আজহারীকেও কফিন কাঁধে নিতে দেখা যায়। তাঁরা কাঁধে নিয়ে মরদেহবাহী গাড়িতে রাখেন। এ সময় গাড়ির চারপাশে সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা দিতে দেখা যায়। কিছুক্ষণ পরে দলের নেতাদের নিয়ে বাসে ওঠেন তারেক রহমান। মরদেহ নিয়ে গাড়িবহর আড়ং, আসাদ গেট হয়ে লেক রোড দিয়ে জিয়া উদ্যানে পৌঁছায়।
দাফনের প্রক্রিয়া চলার সময় তারেক রহমান, তাঁর স্ত্রী জুবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমান, ছোট ভাই আরাফাত রহমানের স্ত্রী শামিলা রহমান, তাঁর বড় মেয়ে জাহিয়া রহমান, ছোট মেয়ে জাফিরা রহমানসহ পরিবারের সদস্যরা এবং বিএনপির নেতা-কর্মী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা দাঁড়িয়ে শোক ও শ্রদ্ধা জানান।
বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয় খালেদা জিয়াকে। কবরে সবার আগে নামেন তারেক রহমান। নিজ হাতে তিনি তাঁর মাকে কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত করেন। দাফনের পর সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।
খালেদা জিয়ার জানাজায় প্রধান উপদেষ্টা ছাড়াও অন্যদের মধ্যে শরিক হন প্রধান বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান ও সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার; এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, লেবার পার্টির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের আহমাদুল্লাহসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা। ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও ছিলেন।