পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাধ্যতামূলক থাকার যে দীর্ঘদিনের নিয়ম ছিল, সেটি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ১৬ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর মতে, জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মসনদের মতো পাসপোর্ট পাওয়া প্রতিটি মানুষের অধিকার এবং এটি অপরাধী শনাক্তের কোনো প্রক্রিয়া হতে পারে না। এই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমিয়ে পাসপোর্ট পাওয়ার পথকে সহজ করবে।
বাংলাদেশে পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে পুলিশের প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করতে হতো, যা প্রায়ই সময়ক্ষেপণ এবং দুর্নীতির কারণ হয়ে দাঁড়াত। অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও অনেক আবেদনকারীকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে, এমনকি ঘুষ দিতে বাধ্য করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া বাতিল হওয়ায় নাগরিকেরা সহজেই তাঁদের বৈধ পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে পারবেন, যা প্রশাসনিক জটিলতা কমাবে।
হ্যাঁ, ভোগান্তি কমবে ঠিকই কিন্তু পরিচয় যাচাই হবে কি? পুলিশ ভেরিফিকেশন হতো আবেদনকারীর পরিচয় ও ঠিকানা সঠিক কি না, তা যাচাইয়ের জন্য। এটি বাতিল হওয়ায় ভুয়া তথ্য দিয়ে একাধিক পাসপোর্ট তৈরির সুযোগ তৈরি হতে পারে। কেননা, জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মসনদ তৈরির বেলায় কোনো কিছু যাচাইয়ের ব্যবস্থা নেই। এনআইডি ও জন্মসনদ জাল করে কেউ যদি নতুন পরিচয় গ্রহণ করে, তাহলে তার জন্য পাসপোর্ট পাওয়া সহজ হয়ে যাবে। একজন ভিন্ন পরিচয়ে একাধিক এনআইডি তৈরি করে প্রতিটি এনআইডি দিয়ে একটি করে পাসপোর্ট তৈরি করে ফেলতে পারে। এ ছাড়া, রোহিঙ্গা শরণার্থী কিংবা অন্য দেশের নাগরিকেরা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্টের মালিক বনে যাওয়াটাও অসম্ভব কিছু না!
এমনকি জঙ্গিবাদে যুক্ত বা গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সহজে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাসপোর্ট পেতে পারে। পুলিশ ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা না থাকলে পরিচয় যাচাই না করিয়ে তারা হয়তো খুব সহজেই বিদেশ যাওয়ার অনুমতি পেয়ে যাবে। ফলে আন্তর্জাতিক অপরাধ বা জঙ্গিবাদে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ধরা না পড়ে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারে।
সরকারের এই সিদ্ধান্ত হয়রানি বন্ধের একটি দারুণ পদক্ষেপ হলেও এটি যেন জাতীয় নিরাপত্তাকে দুর্বল না করে, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। এর জন্য একটি শক্তিশালী ডিজিটাল যাচাই ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যা এনআইডি, জন্মসনদ ও অন্যান্য সরকারি নথির মাধ্যমে আবেদনকারীর পরিচয় নিশ্চিত করবে। প্রতিটি মানুষের আইরিশ এবং আঙুলের ছাপ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার বাসিন্দা বা সন্দেহভাজন আবেদনকারীদের জন্য অতিরিক্ত যাচাই-বাছাইয়ের ব্যবস্থা থাকা উচিত। এবং কেউ যেন একাধিক পাসপোর্টের দাবিদার না হয়, সেই ব্যাপারটিও তদন্ত করতে হবে। পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিকল্প হিসেবে পাসপোর্ট অফিস বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ ইউনিট আবেদনকারীর ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করতে পারে।
হয়রানি বন্ধের পাশাপাশি অপরাধ প্রতিরোধের জন্য কার্যকর ও আধুনিক যাচাইব্যবস্থা গড়ে তোলাই হবে সবচেয়ে যৌক্তিক সমাধান।