হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

শিশুর প্রতি সহিংসতা: ক্ষমাহীন অপরাধ

সেলিম জাহান 

প্রতীকী ছবি

আজকে সারা বিশ্বে শিশুরা ক্রমবর্ধমান নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার। এটা যে শুধু যুদ্ধ কিংবা সংঘাতসংকুল অঞ্চলে ঘটছে, তা-ই নয়, অন‍্যান‍্য অঞ্চলেও এ-জাতীয় সহিংসতা ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের সূত্র অনুসারে, গত বছর বিশ্বব‍্যাপী ২২ হাজারের বেশি শিশুর কুশল এবং নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে, যার মধ‍্যে প্রায় ৮ হাজারই ঘটেছে অধিকৃত ফিলিস্তিনে। ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছর বিশ্বব‍্যাপী শিশু নিপীড়ন ও নির্যাতনের ঘটনা ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। এর মধ‍্যে শিশু ধর্ষণ এবং শিশুদের অন‍্য রকমের যৌন নির্যাতন ৩৪ শতাংশ বেড়ে গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় নয়, অন‍্যান‍্য অঞ্চলেও নিত‍্যদিন ছেলেশিশুদের তুলনায় মেয়েশিশুরাই নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার বেশি হয়।

যুক্তরাজ‍্যে প্রতি চারজন শিশুর মধ‍্যে একজন নিপীড়ন বা নির্যাতনের মুখোমুখি হয়। নাইজেরিয়ায় প্রতি ১০ জন শিশুর মধ‍্যে ছয়জন কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত হয়েছে। বৈশ্বিকভাবে, ১৫-১৯ বছরের কিশোরীদের মধ‍্যে দেড় কোটি কিশোরী তাদের জীবনকালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

বাংলাদেশেও শিশু নিপীড়ন ও নির্যাতন একটি আশঙ্কাজনক সমস‍্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের দুটি সমীক্ষা এবং সেই সঙ্গে ‘বাংলাদেশের পোশাককর্মীদের শিশুসন্তান-সন্ততিদের নিরাপত্তার জন‍্য স্থানীয় পর্যায়ে গ্রহণযোগ‍্য কৌশলসমূহ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় একটি আশঙ্কাজনক চিত্র বেরিয়ে আসে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সমীক্ষা অনুসারে, এ বছরের গত ৯ মাসে ৩৫৯ জন মেয়েশিশু ধর্ষিত হয়েছে, যে সংখ্যা ২০২৪ সালের সারা বছরের মোট সংখ‍্যার বেশি। এর মধ‍্যে মাত্র ৩০০ ঘটনা সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করা হয়েছে। তার মানে, ৫৯টি ঘটনার ব‍্যাপারে কোনো ব‍্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। যারা ধর্ষিত হয়েছে, তাদের বয়সের দিকে তাকালে শিউরে উঠতে হয়। নির্যাতিত মেয়েশিশুদের মধ‍্যে ৪৯ জনের বয়স ৬ বছরের কম, ৯৪ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ বছরের মধ‍্যে এবং ১০৩ জনের বয়স ১৩-১৯ বছর। ১৩৯টি মেয়েশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। একই সময়কালে ৭ থেকে ১২ বছরের ৩০ জন ছেলে ধর্ষিত হয়েছে। যার মধ্যে ২০টি ঘটনা সম্পর্কে অভিযোগ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সমীক্ষার উপাত্তগুলো নেওয়া হয়েছে দেশের ১৪টি জাতীয় পর্যায়ের দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে। এ সমীক্ষা অনুসারে, শুধু গত সেপ্টেম্বরে সারা দেশে ৯২ জন মেয়েশিশু নানান রকমের নিপীড়ন এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তার মধ‍্যে ২৮টি ধর্ষণের ঘটনাও রয়েছে। পোশাককর্মীদের সন্তানদের নিরাপত্তা বিষয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বলা হয়েছে, দেশের ১০ জন মেয়েশিশুর মধ‍্যে ৯ জনই নানান রকমের শারীরিক শাস্তি বা নিপীড়নের শিকার হয়। সেই সঙ্গে এটাও উঠে এসেছে যে ২০২৪ সালের তুলনায় এ বছর নারী নিপীড়নের ঘটনা তিন-চতুর্থাংশ বেড়ে গেছে। সারা দেশে শিশুদের জন‍্য গঠিত আদালতগুলোতে ২৩ হাজার মামলা অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে আছে।

যদিও উপর্যুক্ত তিনটি গবেষণায় ব‍্যবহৃত গবেষণা-প্রণালির মধ‍্যে ভিন্নতা আছে, কিন্তু এর প্রতিটিই কতগুলো আশঙ্কাজনক প্রবণতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। প্রথমত, শিশুদের নির্যাতন নানানভাবে হতে পারে—শারীরিক শাস্তি থেকে মানসিক নির্যাতন, এমনকি যৌন হয়রানি কিংবা ধর্ষণও। দ্বিতীয়ত, সব বয়সের শিশুরা নির্যাতিত হতে পারে, এমনকি একেবারে ছোট্ট শিশুও। তৃতীয়ত, নিজ গৃহ কিংবা নিজ বিদ‍্যালয় বা মাদ্রাসাও শিশুদের জন‍্য নিরাপদ স্থান নয়। কারণ, বহু ক্ষেত্রে অপরাধীরা নির্যাতিত শিশুদের নিকটাত্মীয়, স্বজন, প্রতিবেশী কিংবা শিক্ষক। চতুর্থত, নানান সময়ই ব‍্যক্তিগত কিংবা সামাজিক মানসিকতা, প্রতিবন্ধকতা, পারিবারিক চাপ কিংবা অনিরাপত্তার আশঙ্কার কারণে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপিত হয় না। পঞ্চমত, শিশুদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তার সমাধান করতে দেশের বিচারব‍্যবস্থা চরমভাবে ব‍্যর্থ হয়েছে। শিশু নির্যাতন বিষয়ে আমাদের বিচারব‍্যবস্থায় রাশি রাশি জমে ওঠা অনিষ্পন্ন মামলাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

এসব বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে দুটি প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেয়—এক. শিশুদের, বিশেষত মেয়েশিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা কেন বাড়ছে এবং দুই. এটা প্রতিরোধে কী করা যেতে পারে। প্রথম প্রশ্নটির কোনো সোজা জবাব নেই। বুঝতে হবে, যেখানে অতি ছোট শিশুদেরও এ রকম হীন অপরাধ থেকে রেহাই দেওয়া হয় না, সেখানে সমাজে একটি গভীর নৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক পচন ঘটছে। কারা এসব অপরাধে অপরাধী এবং কী কারণ তাদের এমন জঘন‍্য অপরাধে উদ্বুদ্ধ করে?

মেয়েশিশুদের প্রতি সহিংসতার পেছনে থাকে চরম বিষাক্ত পুরুষতান্ত্রিকতা, যেটা প্রায়ই পুরুষ আরোপিত অবদমন এবং আক্রমণের মাধ‍্যমে প্রকাশ পায়। সমাজে কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুণীদের মধ‍্যে একটি স্বাভাবিক সুস্থ সম্পর্কের অনুপস্থিতির কারণে অবদমিত যৌনতার একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ-জাতীয় অবদমনও মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতার অন্যতম কারণ হতে পারে। বিভিন্ন তথ‍্যপ্রযুক্তি মাধ‍্যমগুলোতে পর্নোগ্রাফিসহ নানা রকমের অশ্লীল বিষয়বস্তু এখন বিস্তৃতভাবে লভ‍্য। এগুলো সাম্প্রতিক সময়ে ছেলেদের মনোজগতে মেয়েদের ব‍্যাপারে একটি অস্বাভাবিক, অসুস্থ বিকৃত মানসিকতার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উপাত্ত এটাও দেখাচ্ছে যে নারীর বিরুদ্ধে সাইবার অপরাধে অপরাধীদের বয়সকাল ১৬ থেকে ৩০ বছরের মধ‍্যে। সেই সঙ্গে শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র এবং ক্রীড়াঙ্গনে মেয়েদের ক্রমাগত সাফল‍্য এবং অর্জন ছেলেদের মনে একটি নিরাপত্তাহীনতা ও হীনম্মন্যতার জন্ম দিচ্ছে। নিরাপত্তাহীনতার এই পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে তাদের হতাশা এবং জীবনের ব‍্যর্থতা। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে মেয়েদের প্রতি ছেলেদের ঘৃণা আর সহিংসতার মাধ‍্যমে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এ চালচিত্রের প্রেক্ষাপটে শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধে কী কী করা যেতে পারে। এর জন‍্য একটি সার্বিক এবং সর্বাত্মক ব‍্যবস্থাকাঠামো প্রয়োজন, যার মধ‍্যে আইনগত, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কার্যক্রম থাকবে। আইনগত দিক থেকে তদন্ত এবং বিচারের ক্ষেত্রে বর্তমান স্থিত দীর্ঘসূত্রতার অবসান হওয়া একান্ত দরকার। তার জন‍্য যারা সহিংসতার শিকার এবং যারা ঘটনার সাক্ষী, তাদের নিরাপত্তা বিধানের জন‍্য প্রয়োজনীয় আইন যথাযথভাবে বলবৎ করতে হবে। নানান সময়ে কলঙ্ক এবং সামাজিক লজ্জার ভয়ে বহু যৌন নির্যাতনের ঘটনা উদ্‌ঘাটিত হয় না, সেগুলো সম্পর্কে অভিযোগও করা হয় না। ফলে যথাযথ ন‍্যায‍্য বিচার বিঘ্নিত হয়। সুতরাং এ বিষয়গুলো পরিবার, বিদ‍্যালয়, মাদ্রাসার মতো সামাজিক পারিপার্শ্বিকতায় খোলাখুলিভাবে আলোচিত হওয়া দরকার। ধর্মীয় নেতারা, সমাজে বিজ্ঞজনেরা যাঁরা আমাদের পথপ্রদর্শক এবং সংবাদমাধ‍্যমে মানুষকে প্রভাবিত করছেন যাঁরা, তাঁরা এসব ব‍্যাপারে জনগণের সচেতনতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটি সবল ভূমিকা রাখতে পারেন।

আনুষ্ঠানিকভাবে একটি অভিযোগ করার পরে বিচারের প্রক্রিয়াকে নষ্ট করার জন‍্য অপরাধী যাতে রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা চাপ প্রয়োগ করতে না পারে, তার জন‍্য একটি কাঠামো প্রতিস্থাপন অত‍্যন্ত জরুরি। যদিও শিশু নির্যাতন রোধের আইনগত কাঠামোর মধ‍্যে তদন্ত ও মামলার নিষ্পত্তির জন‍্য সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়, তবু সেসব ব‍্যাপারে আইনগত অস্পষ্টতা, নির্যাতিত নারীদের বয়ঃসীমা সম্পর্কে বিতর্ক, তদন্ত ফলাফলের অসংগতি সুষ্ঠু বিচারপ্রক্রিয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এসবের নিরসন প্রয়োজন। অপরাধ করেও আইনগত ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে পড়ার সংস্কৃতিকেও রোধ করতে হবে।

সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে পারিবারিক উপদেশ ও নির্দেশনা অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছোট থাকতেই শিশুদের ব‍্যক্তিগত সীমারেখা সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে যে কোন স্পর্শটি গ্রহণযোগ‍্য আর কোনটি নয়। এগুলো লঙ্ঘিত হলে কীভাবে সাহায‍্য চাওয়া যেতে পারে। স্থানীয় পর্যায়ে শিশু নিরাপত্তা পর্ষদ গঠন করলেও তৃণমূল পর্যায়ে শিশু নির্যাতন চিহ্নিতকরণ এবং তার প্রতিকার করার সুযোগ তৈরি করা যায়। পর্নোগ্রাফি এবং ক্ষতিকর তথ‍্যপ্রযুক্তি থেকে শিশুদের রক্ষা করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার।

চূড়ান্ত বিচারে, পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ এবং রাষ্ট্রের সমন্বিত কাজের মাধ‍্যমে শিশুদের, বিশেষত মেয়েশিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার প্রতিরোধ এবং প্রতিকার নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: সেলিম জাহান

ভূতপূর্ব পরিচালক, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি

যেখানে মুক্তিযুদ্ধ বেঁচে থাকে

মা কুকুর ও তার আটটি ছানা

যেথায় হাওয়ায় ভাসে ফুলের কান্না

মিসরের আরেকটি নামকাওয়াস্তে ভোট

ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কি থাকছে

চীন-আমিরাত সামরিক সখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর-বাহির

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শিক্ষা কেন দরকার

ক্যারিয়ার নিয়ে বিভ্রান্তি

বিষ্ণু দের কাব্যচেতনার সমগ্রতা