হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

কোথায় স্বস্তি কাজে

স্বপ্না রেজা

সরকারি অফিসার হওয়ার শখ আমার যতটা না ছিল, তার অধিক ছিল আমার মায়ের। মা চাইতেন, বিসিএস দিয়ে প্রশাসন বা তেমন কোনো সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আমি চাকরি করি। কারণ, এ জায়গা থেকে দেশ ও দশের কল্যাণে কাজ করা যায় অনায়াসে। সরকারি চাকরির সুযোগ-সুবিধাও অনেক। প্রভাবও থাকে সেই সঙ্গে। আমি এমন মানুষও দেখেছি, যাঁরা শুধু অবসর জীবনে নানান সুবিধা গ্রহণের আশায় সরকারি চাকরি করতে চান, বদ্ধপরিকর থাকেন। যার মধ্যে অন্যতম হলো আজীবন পেনশন পাওয়া। এই সুবিধা একজন চাকরিজীবী ব্যক্তিকে আর্থসামাজিক নিরাপত্তা দিয়ে থাকে, তাঁরা এমনটাই মনে করেন। আবার আরেকটা দল আছে যারা ‘সরকারি মাল তো দরিয়ায় ঢাল’ এমন মানসিকতায় উপরি লাভে মোহাচ্ছন্ন থাকে। সরকারি পদপদবিতে থেকে বাড়তি কামাইয়ের পথ পাওয়া যায় বলে তারা মনে করে। ভুক্তভোগীদের মতে, সরকারি কাজ বিনা পয়সায় সম্পন্ন করা যায় না। মানে, সরকারি সুবিধা পেতে টাকা খরচ করতে হয়। এই টাকা যায় সরকারি চাকুরেদের পকেটে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কমিশন। ফলে প্রাণপণ চেষ্টা চলে সরকারি চাকরি পেতে। চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলেও ঘুষ দিয়ে হলেও সরকারি চাকরি তাদের চাই। ফলে ক্লিনার থেকে শুরু করে অফিসার পজিশন, সব ধরনের পদেই চাকরি-বাণিজ্য হতে দেখা গেছে। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি চাকরি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হতে দেখা যায় মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে। অর্থাৎ ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে কারও কারও কপালে সরকারি চাকরি জুটতে দেখা গেছে। নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে অর্থের বিনিময়ে সরকারি চাকরি পাওয়ার ঘটনা কিন্তু বহুদিন ধরেই এবং কম নয়। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবেও কারও কারও সরকারি চাকরি হয়।

যাহোক, মায়ের ইচ্ছা পূরণে ফরম পূরণ করে একদিন প্রিলিমিনারি টেস্ট দিতে হাজির হলাম ঢাকা কলেজে। বিসিএস পরীক্ষার এই অংশের সিট পড়েছে ঢাকা কলেজে। সময়টা ছিল খুব সম্ভবত ১৯৯১ কি ১৯৯২ সাল। পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর খেয়াল করলাম বেশ কিছু পরীক্ষার্থী বই হাতে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা পেছনের দিকের সিটে বসে পরীক্ষা দিতে শুরু করেছেন। সামনে বই খোলা। অবাক হলাম। বিসিএস নাকি সম্মানজনক সরকারি চাকরির পরীক্ষা। সাধারণত মেধাবীরা এই পরীক্ষা দেওয়ার কথা ভেবে থাকেন। যাঁরা এভাবে নকল করে উত্তীর্ণ হয়ে রাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ পদে দায়িত্বশীল হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন, তাঁরা কি আদৌ মেধা যাচাইয়ে অতি উত্তম বা সেরা? প্রশ্নটা মনে উঁকি দিতেই পরীক্ষা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বেরিয়ে এলাম। পরীক্ষার হলের দায়িত্বরত শিক্ষক জানতে চাইলেন, সাদা খাতা ফেরত দিচ্ছি কেন। আমি বই দেখে লেখায় ব্যস্ত পরীক্ষার্থীদের দেখিয়ে বলেছিলাম, কষ্ট করে ওনাদের খাতাটা দিন। ওনাদের বাড়তি খাতার প্রয়োজন হবে। মাকে বলা সম্ভব হলো কেন, কোন যুক্তিতে সরকারি চাকরি করার ইচ্ছেটা মরে গেছে। প্রগতিশীল একজন মা চান তাঁর মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াক, প্রতিষ্ঠিত হোক, বিদ্যা-জ্ঞানের প্রয়োগ ঘটাক।

সিদ্ধান্ত হলো, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তথা এনজিওতে চাকরি করার। নব্বইয়ের দশকে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এনজিওতে কাজ করার বেশ প্রবণতা দেখা যায়। একটা কারণ, সম্ভবত এই সেক্টরে দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মীকে তাঁর দায়িত্বে উপযোগী করে তোলার সুযোগ রাখা হয় এনজিওতে। বেতনও মন্দ নয়। এ ছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের জন্য কাজ করার অফুরন্ত সুযোগ রয়েছে এখানে। যাঁরা সাধারণ ও তৃণমূল পর্যায়ের তথা পিছিয়ে পড়া ও দরিদ্র মানুষের জন্য সরাসরি কাজ করার স্বপ্ন দেখে থাকেন, তাঁদের জন্য এনজিও সেক্টর হলো উত্তম ও উপযুক্ত জায়গা। যাঁরা এনজিওর চাকরিতে প্রবেশ করছেন, মস্তিষ্কে তাঁদের সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকারের বীজ বপনে সহায়তা করছেন তাঁদেরই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং যাঁরা সংস্থার কর্ণধার।

যাহোক, বৃহত্তম একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরির সুযোগ হলো। সরকারি চাকরির সঙ্গে এনজিওর চাকরির পার্থক্য বেশ। চিন্তা, চেতনা, কাজ করার পরিবেশ-পরিস্থিতি তথা সংস্কৃতি একদম আলাদা। অনেকটা তেল ও পানির মতো। কোনোভাবেই দ্রবীভূত হওয়ার সুযোগ নেই। তবে মিলটা হলো, দুটোই তরল। তার মানে হলো, এখানেও সুবিধাভোগী সরকারি চাকরিজীবীদের মতো সুবিধাভোগী উন্নয়নকর্মী রয়েছেন। তবে এই সুবিধাভোগীরা প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পর্যায়ের। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত অনেক সংস্থা রাষ্ট্রীয় হলেও ব্যক্তিমালিকানার অ্যাটিচিউডে পরিচালিত হতে শুরু করে। প্রায় প্রতিটি এনজিওতে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের সঙ্গে ঊর্ধ্বতনের বেতনকাঠামোর মধ্যে চরম বৈষম্য দেখা যায়। বৈষম্য দেখা যায় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রেও। আত্মীয়করণ, স্বজনপ্রীতি তো রয়েছেই। অনেকেই মনে করেন যে যোগ্যতা থাকুক, আর না থাকুক নিজের লোককে দায়িত্বে বসানো হয় প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহীদের সুরক্ষিত করতে।

সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো, যেসব দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করা হয়, তাদের জীবনে পরিবর্তন যদি আসে ১০ ভাগ, আর যাঁরা তাদের জন্য করে সেই এনজিওর প্রতিষ্ঠাতা ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার জীবনে পরিবর্তন আসে ৭০ ভাগ। বাকি ২০ ভাগ এনজিওসংশ্লিষ্টদের, যাঁরা এনজিও কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহায়তা করেন। যদি জরিপ করা হয় সততার সঙ্গে, তাহলে এ রকম একটা চিত্র পাওয়া যাবে বলে অনেকেই মনে করে থাকেন। মানবতা, কল্যাণ, উন্নয়ন শব্দগুলো দিয়ে কাজ শুরু হলেও আর্থিকভাবে লাভবান হতে কোনো কোনো সংস্থা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয় অতি মুনাফালাভে।

অভিজ্ঞতা বলে, সরকার ও এনজিও সব সময়ই একে অন্যের কঠোর সমালোচক হয়ে থেকেছে। সমন্বয়, সমঝোতা কম দেখা গেছে। সরকার এনজিওকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেছে, আর এনজিও সরকারকে মনে করেছে প্রতিবন্ধক হিসেবে। মজার বিষয় হলো, একটা পর্যায়ে আবার কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তার এনজিও প্রতিষ্ঠার তৃষ্ণা দেখা গেছে যেমন, তেমনই আবার এনজিও কর্মকর্তার সরকারের অংশ হওয়ার আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়েছে। বৈষম্য ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক মানসিকতা কিন্তু এনজিওতে রয়েছে। গবেষণা হলে এর ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যাবে বলে মনে করি। দারিদ্র্যবিমোচনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে যাওয়া অনেক এনজিও ব্যক্তি যেভাবে মাঠে রাজকীয় আয়েশ খোঁজেন, ভোগ করেন তা বৈষম্যের সীমাকেও লঙ্ঘন করে। সরকারি চাকরির অনিয়ম যেভাবে প্রকাশ্যে আসে, এ ক্ষেত্রে তা আসে না। অন্যতম কারণ সম্ভবত মানবতা ও কল্যাণের দোহাই। তবে এটা ঠিক যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ ও নারীদের এগিয়ে নিতে এনজিওর ভূমিকা অপরিসীম।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি

অসময়েই শত্রু-মিত্র, মীরজাফর ও বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়

খেলা কি তবে এবার মুখ ও মুখোশের

বুদ্ধিজীবী দিবস যেন ভুলে না যাই

উড়োজাহাজগুলোও পরিবেশের ক্ষতি করছে

যে প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে হবে

পুতিনের ভারত সফর: আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিতে কী বার্তা দেয়

বিজয়ের মাসে শঙ্কার কথা বলি

পথকুকুর-বিড়াল হত্যা: আইন এবং শাস্তি