জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার রায় আজ সোমবার ঘোষণা হতে যাচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে এটিই প্রথম যেটির রায় ঘোষণা করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
রায় ঘোষণার কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করার কথা রয়েছে। বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই গুরুত্বপূর্ণ রায় ঘোষণা করবেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
প্রধান আসামি শেখ হাসিনা ও দুই সহযোগী
এই মামলার প্রধান আসামি হলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সঙ্গে অন্য দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিন আসামির মধ্যে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান পলাতক এবং তাঁরা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন।
মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া একমাত্র আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ট্রাইব্যুনালে নিজের দোষ স্বীকার করে ‘রাজসাক্ষী’ বা ‘অ্যাপ্রুভার’ হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তিনি উল্লেখ করেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি ‘প্রাণঘাতি’ (লেথাল উইপন) ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই নির্দেশ তিনি গত বছরের ১৮ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মাধ্যমে পেয়েছিলেন।
প্রসিকিউশনের দাবি: মাস্টারমাইন্ড ও মৃত্যুদণ্ডের প্রত্যাশা
মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ (প্রসিকিউশন) একাধিকবার দাবি করেছে, শেখ হাসিনা ছিলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী সব ধরনের অপরাধের মাস্টারমাইন্ড (মূল পরিকল্পনাকারী), হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার (সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা)।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে প্রাণঘাতি ব্যবহার করে নিরীহ, নিরস্ত্র দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয় এবং ৩০ হাজার মানুষকে আহত করা হয়েছিল।
যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় প্রসিকিউশন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে। একই সঙ্গে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে জুলাইয়ে শহীদ পরিবার এবং আহত আন্দোলনকারীদের মধ্যে হস্তান্তরের আবেদন জানানো হয়েছে। অন্যদিকে, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী তাঁদের খালাস চেয়েছেন।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৫টি অভিযোগ
শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে, যা প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করার দাবি করেছে। অভিযোগগুলো হলো:
১. উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান;
২. প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ;
৩. রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা;
৪. রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনরত ছয়জনকে গুলি করে হত্যা;
৫. আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা।
ইন্টারপোলে ‘রেড নোটিশের’ প্রস্তুতি
প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম গতকাল রোববার ব্রিফিংয়ে বলেন, যদি ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাকে শাস্তি দেন, তবে প্রসিকিউশন তাঁর বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে আরেকটি ‘কনভিকশন ওয়ারেন্টের’ (দণ্ডাদেশের পরোয়ানা) আবেদন করবে। এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) আবেদন করেছিল।
এর আগে ছয় মাসের সাজা দেন ট্রাইব্যুনাল
আদালত অবমাননার একটি মামলায় গত ২ জুলাই শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। চলতি বছরের এপ্রিলে মামলাটির বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।
‘২২৬ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি’—শেখ হাসিনার এমন একটি বক্তব্যের অডিও রেকর্ড অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছিল চলতি বছরের শুরুর দিকে। ‘তাঁর এমন বক্তব্য বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা’ উল্লেখ করে আদালত অবমাননার মামলা করেছিল প্রসিকিউশন। সেই মামলায় শেখ হাসিনাকে সাজা দেন ট্রাইব্যুনাল।