৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮। বেলা ২টা। ফ্রান্সের দক্ষিণের বন্দরনগর মার্শাইয়ের অদূরে উপকূলে জেলেদের জালে উঠে এল ছোট্ট একটি ধাতব খণ্ড। অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে তন্নতন্ন করে খোঁজ করা হচ্ছিল ইতিহাসের অংশ এই অমূল্য বস্তু। খবরটি বিদ্যুতের গতিতে ছড়িয়ে পড়ল পুরো দেশে। সংবাদকর্মীদের মধ্যে দেখা দিল চাঞ্চল্য। রাত ৮টায় সব টিভি চ্যানেলের প্রধান খবরে ফলাও করে প্রচার করা হলো সংবাদটি।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক ফরাসি সেনার হাতের কবজিতে এমন একটি ধাতব টুকরো বেঁধে দেওয়া হতো, তাতে খোদাই করা থাকত সেনার নাম ও পরিচয়। ধাতব টুকরোটি খানিকটা পরিষ্কার করতেই যাঁর নাম ফুটে উঠল, তাঁকে চেনে না, এমন লোক ফ্রান্সে নেই বললেই চলে।
তিনি হলেন আঁতোয়ান সাঁ এগজ্যুপেরি, ফরাসি বৈমানিক ও লেখক। তবে এই পরিচয়ের আড়ালে তাঁর আরও পরিচয় আছে—তা হলো, তিনি একজন মানবতাবাদী চিন্তাবিদ, দার্শনিক এবং কবি। সাংবাদিকতাও করেছেন বহুদিন। অবশেষে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে হারিয়ে গেছেন তিনি। রহস্য ডানা মেলে দানা বেঁধেছে সেখানেই।
বাস্তিয়া সামরিক বিমানঘাঁটি থেকে ১৯৪৪ সালের ৩১ জুলাই নাৎসি বাহিনীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ এবং বিমান থেকে ছবি তুলতে পি-৩৮ লাইটেনিং বিমানে করে তিনি একাই ফ্রান্সের উপকূলে গিয়েছিলেন। এরপর আর ফিরে আসেননি। তাঁর ভাগ্যে কী ঘটেছিল, আজও তা সবার অজানা। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও সাগরে, পাহাড়ে, জঙ্গলে দিনের পর দিন অভিযান চালিয়ে তাঁকে এবং তাঁর বিমানটিকে খোঁজা হয়। কিন্তু সব চেষ্টা বৃথা। রহস্যের চাদর মুড়ি দিয়ে তিনি হারিয়ে গেলেন।
ধাতব টুকরোটির সূত্র ধরে আঁতোয়ানের বিমানটি সাগরের তলদেশ থেকে উদ্ধার করা হয়। বিমানটি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেও কীভাবে এবং কী কারণে এটি সাগরে আছড়ে পড়েছিল, বিশেষজ্ঞরা আজও তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
এ সময়ে তিনি লিখেছেন বেশ কিছু বই। মধ্যে জনপ্রিয়তা পায় ‘ছোট্ট রাজপুত্র’ বইটি। ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে। রূপকথার ছলে তিনি গভীর জীবনদর্শনের জাদুকরি ছবি এঁকেছিলেন তুলি ও কলমে। মাত্র ৯৩ পৃষ্ঠার বইটি ৩০০টি ভাষা, উপভাষায় ভাষান্তরিত হয়েছে এবং আট দশকে বিক্রি হয়েছে ২০ কোটির বেশি কপি।
জীবন একটাই। আঁতোয়ান দ্য সাঁ এগজ্যুপেরি তাঁর ৪৪ বছরের জীবনে ধারণ করেছিলেন বহু জীবন। উড়োজাহাজের জগতের রাজপুত্র, তিনি হারিয়ে গেলেও রেখে গেছেন তাঁর অমর সৃষ্টি, ‘ছোট্ট রাজপুত্র’।