বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ৯১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ নাগরিক মুসলমান। ইসলাম শুধু একটি ধর্ম নয়, এটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এবং নৈতিকতা, শিষ্টাচার, মানবিকতা ও সমাজ গঠনের পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। এই ইসলামের বনিয়াদি শিক্ষা যদি শিশু বয়সেই আগামী প্রজন্মের হৃদয়ে সঞ্চারিত না হয়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নৈতিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়বে। এ জন্য দেশের প্রায় ৬৫ হাজার প্রাইমারি স্কুল তথা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি।
নৈতিকতার প্রথম পাঠ
প্রাথমিক বিদ্যালয় হলো শিক্ষার্থীদের জীবনের প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষাঙ্গন। এখানেই গড়ে ওঠে তাদের চিন্তা, চরিত্র ও মূল্যবোধের ভিত। এই স্তরে শিশুরা যে শিক্ষা পায়, তা-ই তার সারা জীবনের নৈতিক ও মানসিক গঠন নির্ধারণ করে। যদি এই পর্যায়ে ইসলামের মৌলিক বিষয়—ইমান, আকিদা, কোরআন তিলাওয়াত, নামাজ, রোজা, আদব-আখলাক ইত্যাদি শেখানো না হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধর্মীয় দিক থেকে পিছিয়ে পড়বে। আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক। যদি ছোটবেলা থেকেই সঠিকভাবে ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে, তবে তারা বড় হয়ে সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ, দায়িত্বশীল ও সৎ মানুষ হিসেবে সমাজে অবদান রাখবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় শিক্ষার ঘাটতি
বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ইসলাম শিক্ষা পাঠ্যসূচিতে থাকলেও বাস্তবে তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। বিষয়টাও আরও ঢেলে সাজানো দরকার। এ ছাড়া অধিকাংশ বিদ্যালয়ে আলাদা ধর্মীয় শিক্ষক নেই। সাধারণ শিক্ষকেরা অন্য বিষয় পড়ানোর পাশাপাশি ধর্ম শিক্ষা পড়ান, ফলে ধর্মীয় বিষয়গুলো শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। ইসলামের বনিয়াদি বিষয়, বিশুদ্ধ কোরআন তিলাওয়াত, প্রয়োজনীয় দোয়া-কালাম, ইমান-আকিদার মৌলিক বিষয়, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, নবী-রাসুলের প্রতি বিশ্বাস, ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস, আখিরাত ও তাকদিরের ধারণা ইত্যাদি শিশুরা সঠিকভাবে জানতে পারে না। এতে তাদের ধর্মীয় ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তারা ইসলামি মূল্যবোধ থেকে ধীরে ধীরে বিচ্যুত হতে থাকে।
ইসলামি শিক্ষার গুরুত্ব
ইসলামে জ্ঞান অর্জনকে ফরজ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ প্রথম ওহি নাজিল করেই বলেন, ‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা আলাক: ১)। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি, যে কোরআন শেখে এবং তা শিক্ষা দেয়।’ (সহিহ বুখারি)। তাই শিশুদের কোরআনের হরফ, তিলাওয়াত, অর্থ ও আদর্শ শেখানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বিষয়। প্রাথমিক স্তরে একজন ইসলামি শিক্ষক থাকলে শিশুদের মধ্যে এই ধর্মীয় অনুপ্রেরণা জাগ্রত হবে।
জাতীয় ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ধর্মীয় শিক্ষা
ধর্মীয় শিক্ষা সমাজে সহনশীলতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবিকতা জাগ্রত করে। যদি শিশু বয়সেই ইসলাম ধর্মের আদর্শে লালিত হয়, তাহলে তারা বড় হয়ে চরমপন্থা, ঘৃণা বা সহিংসতায় জড়াবে না। ইসলাম শেখায়, ‘ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই’। এই মৌলিক নীতিটি বুঝে নিলে শিশুরা অন্য ধর্মের মানুষকেও সম্মান করতে শেখে। ফলে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামি শিক্ষা হলো সেই আলোর প্রদীপ, যা জাতিকে নৈতিক অন্ধকার থেকে মুক্ত করে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।
জাতীয় শিক্ষানীতিতে ধর্মীয় শিক্ষার অবস্থান
বাংলাদেশের ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতেও বলা আছে, ‘শিশুদের নৈতিক ও মানবিক বিকাশের জন্য ধর্মীয় শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে।’ কিন্তু নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকলেও বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়ে গেছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিশাল অংশে আজও ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষক নেই। ফলস্বরূপ, ধর্ম শিক্ষা পাঠ্যবই থাকলেও তা শিশুর অন্তরে যথাযথ প্রভাব ফেলতে পারছে না। যদি এই নীতিকে বাস্তবায়ন করতে হয়, তবে প্রতিটি বিদ্যালয়ে একজন যোগ্য ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া অপরিহার্য।
বিদেশে ধর্মীয় শিক্ষার দৃষ্টান্ত
অনেক উন্নত মুসলিম দেশ যেমন সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত—তাদের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষাকে প্রাথমিক স্তর থেকেই বাধ্যতামূলক করেছে। এমনকি অনেক অমুসলিম দেশেও মুসলিম সম্প্রদায়ের শিশুদের জন্য ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ নামে আলাদা বিষয় চালু আছে। তাহলে প্রায় ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে কেন শিশুদের ইমানি শিক্ষার জন্য একজন ইসলামি শিক্ষক থাকবেন না?
চাই প্রশিক্ষিত দক্ষ শিক্ষক
ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি তাঁদের সঠিক প্রশিক্ষণও অত্যন্ত জরুরি। আধুনিক যুগের শিশুরা কেবল মুখস্থনির্ভর শিক্ষা নয়, ব্যাখ্যামূলক ও বাস্তবজীবনভিত্তিক শিক্ষায় আগ্রহী। তাই এই শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজন—শিশু মনোবিজ্ঞানে প্রশিক্ষণ, আধুনিক শিক্ষণপদ্ধতির জ্ঞান, বিশুদ্ধ কোরআন তিলাওয়াত, কোরআন-হাদিস ও ফিকহে মজবুত দক্ষতা, নৈতিক আদর্শে দৃঢ় অবস্থান এবং নিজে ইসলাম পরিপালনকারী।
এ ক্ষেত্রে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস পাস ও প্রশিক্ষিত আলেমকে উপযুক্ত। পাশাপাশি নুরানি ট্রেনিংপ্রাপ্ত হলে কোমলমতি শিশুদের জন্য সোনায় সোহাগা হবে। তাহলে একদিকে যেমন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব পূরণ হবে, অন্যদিকে হাজার হাজার কওমি আলেমের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে এবং একটি ভিন্ন অঙ্গনে মনপ্রাণ উজাড় করে আগামী প্রজন্মকে গড়ে তোলার সুযোগ পাবেন। এমন একজন ধর্মীয় শিক্ষকই বিষয়গুলো শিশুদের কাছে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে পারবেন।
শেষ কথা হলো, প্রায় ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ জাতীয় দায়িত্ব ও সময়ের দাবি। শিশুরা যদি ধর্মীয়ভাবে শিক্ষিত হয়; তারা সৎ, ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী এবং সমাজে শান্তি ও মানবতার দূত হয়ে উঠবে। তাই প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবিলম্বে একজন করে ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হোক। এটি শুধু শিক্ষাব্যবস্থাকে নয়, পুরো জাতিকে নৈতিকভাবে শক্তিশালী করবে।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম; পরিচালক, সম্পাদনা কেন্দ্র।