ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের আগমনী ইতিহাস সুদূর প্রাচীন ও বৈচিত্র্যময়। বিশেষত দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্য ইসলামের প্রাচীনতম স্থাপত্যের নিদর্শনের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। আরব সাগরের উপকূলবর্তী এই অঞ্চলে আরব বণিকদের নিয়মিত আগমনের সূত্রে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল। সেই ঐতিহাসিক সময়ের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আজও টিকে আছে কেরালার কয়েকটি প্রাচীন মসজিদ। এই প্রবন্ধে কেরালার তিনটি উল্লেখযোগ্য প্রাচীন মসজিদ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
চেরামান জুমা মসজিদ
কেরালার থ্রিসুর জেলার কোডুঙ্গাল্লুর এলাকায় অবস্থিত চেরামান জুমা মসজিদকে ভারতের প্রাচীনতম মসজিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী, এই মসজিদ ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায়ই নির্মিত হয়েছিল। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে, চেরা রাজবংশের রাজা চেরামান পেরুমাল চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার স্বপ্ন দেখে আরবে যান এবং সেখানে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। মক্কা থেকে ফেরার পথে তিনি কয়েকজন সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে এসে কেরালায় এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও এই বর্ণনার ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবু এই মসজিদের প্রাচীনত্ব অনস্বীকার্য।
চেরামান জুমা মসজিদের স্থাপত্যশৈলী অনন্য। এটি কেরালার ঐতিহ্যবাহী হিন্দু মন্দিরের স্থাপত্যরীতির সঙ্গে ইসলামিক উপাদানের এক সমন্বয়। মসজিদের ভেতরে একটি তেল প্রদীপ রয়েছে। কথিত আছে, নবী (সা.)-এর যুগ থেকে এটি অবিরাম জ্বলছে। কাঠের স্তম্ভ, ঢালু ছাদ এবং উঠান—এগুলো স্থানীয় স্থাপত্যরীতির প্রতিফলন। এই মসজিদটি কেবল একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং ভারতে ইসলামের প্রাচীন উপস্থিতির এক জীবন্ত প্রমাণ।
মসজিদে বিলাল
কেরালার মালাপ্পুরম জেলায় অবস্থিত মসজিদে বিলাল আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রাচীন মসজিদ।
এই মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হজরত বিলাল (রা.)-এর নাম অনুসারে। স্থানীয়ভাবে জনশ্রুতি আছে, হজরত বিলাল (রা.)-এর কোনো অনুসারী এই অঞ্চলে এসে ইসলামের প্রচার করেছিলেন। যদিও এই বর্ণনার সত্যতা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত নয়, তবু মসজিদটির প্রাচীনত্ব এবং ধর্মীয় গুরুত্ব অপরিসীম।
মসজিদে বিলালের স্থাপত্যশৈলী কেরালার অন্যান্য প্রাচীন মসজিদের মতোই। কাঠের তৈরি স্তম্ভ, ঐতিহ্যবাহী কেরালীয় ছাদ এবং সরল অলংকরণ এই মসজিদের বৈশিষ্ট্য। মসজিদের প্রাঙ্গণে একটি প্রাচীন কূপ রয়েছে, যার পানিকে স্থানীয়রা পবিত্র বলে বিশ্বাস করে। মসজিদটি স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
পালায়াম মসজিদ
কেরালার কোল্লাম জেলায় অবস্থিত পালায়াম মসজিদ আরেকটি প্রাচীন ইসলামি স্থাপনা।
ধারণা করা হয়, এই মসজিদটি নবম শতাব্দীতে আরব বণিকদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। সেই সময় মসলা বাণিজ্যের কারণে আরব বণিকেরা এই অঞ্চলে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন এবং অনেকেই কেরালায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁদের বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে কেরালার মুসলিম সমাজ বা ‘মাপ্পিলা’ সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে।
পালায়াম মসজিদের স্থাপত্যেও কেরালার ঐতিহ্যবাহী নির্মাণশৈলীর ছাপ স্পষ্ট। মসজিদটি কাঠ ও ইট দিয়ে নির্মিত এবং এর ছাদ টালি দিয়ে আচ্ছাদিত। অভ্যন্তরে প্রাচীন আরবি ক্যালিগ্রাফি ও কারুকাজ দেখা যায়। মসজিদের পাশে একটি প্রাচীন কবরস্থান রয়েছে, যেখানে আরব বণিক ও প্রথম যুগের মুসলমানদের সমাধি রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে মসজিদটি সংস্কার করা হলেও এর মূল কাঠামো এবং ঐতিহাসিক চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে।
লেখক: শিক্ষার্থী, শরীফবাগ ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা