হোম > বিশ্ব > মধ্যপ্রাচ্য

যেভাবে ভোর হয় তেহরান ও তেল আবিবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­

ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত হানে ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবের রামাত গেন এলাকায়ও। ছবি: এএফপি

গত শুক্রবার ভোররাতে ইসরায়েলের প্রথম মিসাইল আঘাত হানার সময় ঘুম ভেঙে উঠে শাহরাম দেখেন, তাঁর আশ্রয় নেওয়ার মতো নিরাপদ কোনো জায়গা নেই। তেহরানের একটি আবাসিক ভবনে স্ত্রীসহ বাস করেন এই সাংবাদিক। ঘরের ভেতরে একটি খাবার টেবিলের নিচে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেন। বিস্ফোরণে সে সময় দুলছিল দেয়াল, কাঁপছিল জানালা। শাহরাম বলেন, ‘এমন সন্ত্রাস আমি আগেও একবার অনুভব করেছি, ৮০-এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধে যখন বাগদাদের মিসাইল তেহরানে এসে পড়েছিল। তখন অন্তত সাইরেন ও শেল্টার ছিল। এখন কিছুই নেই।’

এই দৃশ্যের প্রায় ১ হাজার ২০০ মাইল দূরে গতকাল শনিবার সকালে ইসরায়েলের তেল আবিব শহরের বাসিন্দারা ঘর থেকে বেরিয়ে দেখতে পান এক অন্য রকম শহর—ফাঁকা রাস্তা, দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া গাড়ি, ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসাবশেষ। তেহরান ও তেল আবিব—দুই শহরই এবার সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে।

বছরের পর বছর ইয়েমেন থেকে লেবানন পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে আসা ইরান ও ইসরায়েল এবার সরাসরি একে অন্যকে লক্ষ্য করে মিসাইল ছুড়ছে। ইসরায়েলের হামলায় তেহরানের অনেক জায়গায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি হয়েছে।

তেহরানের শাহরারা এলাকায় থাকতেন কবি ও ইংরেজি শিক্ষিকা পারনিয়া আব্বাসি। ২৩ বছর বয়সী এই কবি সপরিবারে নিহত হয়েছেন। তাঁর রক্তাক্ত শরীর ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে ছিল। ইসরায়েলি মিসাইল একাধিক ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে, মারা গেছে দুই মাস বয়সী শিশু ইয়ারান ঘাসেমি, প্যাডেল খেলোয়াড় পারসা মনসুর, আলবোরজ অঞ্চলের ঘোড়দৌড় দলের সদস্য মেহদি পুলাদভান্দসহ আরও অনেকে।

এদিকে ইরানের পাল্টা হামলার পর ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবের স্টার্টআপকর্মী ইয়ায়েল ওয়েইনরেব বলেন, ‘এই বিস্ফোরণের শব্দ ছিল অন্য রকম। আশ্রয়কেন্দ্রে বসেই আমরা দেখেছি, শহরে আঘাত হানার সেই মুহূর্ত।’

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত শুক্রবার সকালে জাতির উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘নিরাপদ আশ্রয়ে দীর্ঘ সময় থাকার জন্য প্রস্তুত থাকুন। খাবার, পানি, ও ধৈর্য মজুত রাখুন।’

তেল আবিবের বেশির ভাগ ভবনে নিরাপদ কক্ষ নেই। ইরিত নামের এক তথ্যচিত্র নির্মাতা বলেন, ‘তৃতীয় হামলার আগে কোনো সতর্কতা পাওয়া যায়নি, শুধু সাইরেন শুনে আমরা বাড়ির বাইরে ছুটে যাই। কোথায় মিসাইল পড়বে, সেটা ছিল শুধু ভাগ্যের ব্যাপার।’

ইসরায়েলি হামলায় নিহত কবি পারনিয়া আব্বাসি। ছবি: সংগৃহীত

তেহরানের আতঙ্কিত সকাল

তেহরানের মধ্যাঞ্চলের এক কেকের দোকানে কাজ করেন আমিন। তাঁর বাসা ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনির বাসভবনের কাছেই। গতকাল শনিবার ভোরে বিস্ফোরণের সময় তাঁর ঘরটি ভূমিকম্পের মতো কাঁপছিল। আমিন বলেন, ‘আমি ধরে নিয়েছিলাম, আগের মতো সামরিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। কিন্তু এবার চারপাশে বিস্ফোরণ চলছিল। আমি ভয় পেয়ে ডকুমেন্টস, ল্যাপটপ ব্যাগে ভরে দরজায় বসে থাকি।’ সকাল ৯টায় কাজে গেলেও পথে সেনাসদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখেছেন তিনি। তবে দোকান, ক্যাফে খোলা ছিল। পেট্রলপাম্পে লাইন ছিল বেশি।

ইসরায়েল টার্গেট করেছে তেহরানের উত্তর-পূর্বের বিলাসবহুল এলাকাগুলোকেও। লুই ভুইতন, শোপার্ডের মতো দোকানে নিয়মিত কেনাকাটা করা ইরানের অভিজাতেরা এবার যুদ্ধের বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। উত্তর তেহরানের গৃহবধূ মরিয়ম বলেন, ‘আমাদের পাশের ভবনে আঘাত হেনেছে। জানালা কেঁপে উঠেছিল। রাস্তায় মরদেহ পড়ে ছিল। এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না।’

পারমাণবিক শঙ্কা ও দ্বিতীয় রাতের আতঙ্ক

ইসরায়েলি হামলায় ইরানের নাতানজ শহরের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রও আক্রান্ত হয়েছে। তাই শহরের বাইরে যাতায়াত বন্ধ। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ কার্যত বন্দী। পরমাণুকেন্দ্র থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ালে কী করতে হবে, সেই বিষয়ে কোনো গাইডলাইন দেওয়া হয়নি। অনেকে মনে করছেন, নাতানজ ইরানের চেরনোবিল হতে পারে।

গত শুক্রবার রাতে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় হলেও আগের রাতে তারা কেন নিষ্ক্রিয় ছিল, সেই প্রশ্ন উঠেছে। গতকাল সকাল পর্যন্ত বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল রাজধানীবাসীর। পুলিশ ব্যবসায়ীদের দোকান বন্ধ রাখতে অনুরোধ করে। এর ফলে কার্যত লকডাউনে ছিল শহরটি।

তেল আবিবেও আতঙ্ক

গত শুক্রবার রাতে ইরানে ৭৮ জন নিহত হলেও ইসরায়েলে প্রাণ গেছে তিনজনের, আহত ৭৬। সামরিক বাহিনী সতর্ক করেছে, এ ধরনের হামলা আরও দিনের পর দিন চলতে পারে। আকাশপথও দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকতে পারে।

এই শহরে একটি বিয়েতে অংশ নিতে এসে পরিবার নিয়ে আটকা পড়েছেন ডেভিড সিল নামের এক ব্রিটিশ। তিনি বলেন, ‘আগে হেঁটে বেড়িয়েছি, রেস্তোরাঁতে খেয়েছি। এখন যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। রাত ৩টার সময় বোম শেল্টারে গিয়ে ফোনে খবর দেখি—তেল আবিবে আঘাত লেগেছে। ঘুমাতে পারিনি, বারবার জেগে উঠেছি। এখন বাড়ি ফিরতে চাই, কিন্তু কীভাবে ফিরব, জানি না।’

‘গণতন্ত্র মিসাইল দিয়ে আসে না’

নেতানিয়াহু ইরানিদের আহ্বান জানিয়েছেন, নিজেদের সরকার পতনে এগিয়ে আসতে। কিন্তু ইরানিরা এই আহ্বান ঘৃণা নিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা মিনা আকবারি ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, ‘যারা ইরানকে যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্ত করতে চায়, তারা ইতিহাস জানে না বা ধ্বংস থেকে মুনাফা পায়। গণতন্ত্র ফাইটার জেটে আসে না, আসে মানুষের আন্দোলনে।’

ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

ইসরায়েলের জনগণও যুদ্ধক্লান্ত। গাজা যুদ্ধ শেষ করে বন্দীদের ফিরিয়ে আনার পক্ষে অধিকাংশ। কিন্তু এখনকার ভয় ভিন্ন। তেল আবিবের নির্মাতা ইরিত বলেন, ‘যা আসছে, তা আরও ভয়াবহ। আতঙ্ক বাড়ছে। সামনে কী ঘটবে, কেউ জানে না। আমরা এক অজানা, ধ্বংসাত্মক ভবিষ্যতের মুখোমুখি।’

গাজায় হামাসবিরোধী ইসরায়েলি প্রক্সি গোষ্ঠীর নেতা ইয়াসির আবু শাবাব নিহত, কে তিনি

গাজায় যুদ্ধবিরতি খুব ভালোভাবে চলছে, দ্বিতীয় ধাপ শুরু শিগগির: ট্রাম্প

মার্কিন মধ্যস্থতায় ৪০ বছরের মধ্যে প্রথমবার সরাসরি আলোচনায় লেবানন-ইসরায়েল

ফিলিস্তিনের নেলসন ম্যান্ডেলা: বারঘৌতির মুক্তির দাবিতে সোচ্চার দুই শতাধিক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব

‘সর্বত্র ভূত দেখে’ যত্রতত্র ‘বোমা ফেলছেন বিবি’, লাগাম টানতে ব্যর্থ যুক্তরাষ্ট্র

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রই একমাত্র সমাধান—পোপ

দুর্নীতির মামলায় প্রেসিডেন্টের কাছে নেতানিয়াহুর ক্ষমা প্রার্থনা

গাজার পুলিশ বাহিনী গঠনে হাজারো ফিলিস্তিনিকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে মিসর

যুদ্ধবিরতির মধ্যেও গাজায় ইসরায়েলি হামলা চলছে, নিহত ৭০ হাজার ছাড়াল

সংঘবদ্ধ নির্যাতন ‘কার্যত’ ইসরায়েলের রাষ্ট্রনীতি, কুকুর হামলা, যৌন নির্যাতনের চিত্র জাতিসংঘের প্রতিবেদনে